রাইনহোল্ড মেসনার, যাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা পর্বতারোহী হিসাবে ধরা হয়। ২০০৩ সালের ৩০ শে মার্চ জনপ্রিয় গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাঁর একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাত্কারে মেসনার তাঁর পর্বতারোহী জীবন, তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু ও অন্যান্য বিষয়ে খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু অনেক গভীর ও স্পষ্টভাবে বলেছেন। 

রাইনহোল্ড মেসনার: “আমি এতটুকুই জানি”

১৯৭৮ সালে যখন আমরা অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টে ওঠার প্রস্তাব দিয়েছিলাম তখন লোকেরা আমাদের বলেছিল এটা সম্ভব নয়, আমরা আমাদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছি। তারা বলেছিল আমরা সেখানে আমাদের মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলব। আমরা যখন অভিযানে যোগ দিয়েছিলাম অস্ট্রিয়ান অভিযানের প্রথম পর্বতারোহীরা নেমে আসছিল, তারা বলেছিল যে আমাদের চেষ্টা করা উচিত হবে না। এটি কঠিন ছিল: আমি জানি না আমার এভারেস্টে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা, এবং এভারেস্ট হচ্ছে এভারেস্ট। আমি তখনও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে আমি চেষ্টা করবো এবং যতটা সম্ভব উপরে উঠবো।

১৯৮০ সালে বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট একা আরোহণ করা আমার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। আমি সেখানে একা ছিলাম, সম্পূর্ণ একা। আমি রাতে একটি ক্র্যাভ্যাসে পড়ে গিয়েছিলাম এবং প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম। দুই বছর ধরে একাকী এভারেস্ট আরোহণের কল্পনা আমি নিজের মধ্যে ধারন করছিলাম – কেবল আমার এই কল্পনাটি ছিল বলেই আমি নিজেকে এগিয়ে নিতে পেরেছিলাম।

আপনি যখন কোন পর্বতে উঁচুতে থাকবেন তখন আপনি সত্যিকারের আপনি ছাড়া আর কিছুই হতে পারেন না।

ম্যালরি বলেছিলেন যে তিনি এভারেস্টে উঠেছিলেন কারণ সেটি সেখানে ছিল বলে। আমি মনে করি আমরা উপরে গিয়েছি যাতে আমরা আবার নীচে ফিরে আসতে পারি। এই নেমে আসা একটি খুব শক্তিশালী অভিজ্ঞতা। আপনি একটি অমানবিক জায়গা থেকে ফিরে আসেন। আমরা এর জন্য তৈরি নই, এই নিঃসঙ্গতা এবং শীতলতা। আপনি ফিরে এসে পুনঃজাগরণ  বোধ করেন, আপনি চিন্তা করবেন আপনার কাছে নতুন সুযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞতাটি এতই শক্তিশালী যে আপনি এটি বারবার পেতে চাইবেন, তবে এর জন্য আপনাকে ভোগান্তি পোহাতে হবে। এটি নেশার মত।

ছোটবেলাতে কোন কিছু না ভেবেই আমি এগুলো পেয়েছিলাম: আমি একটি ভাল পথ খুঁজে পেতে পারি, দ্রুত আবহাওয়া বুঝতে পারি, এই পাথরটি ভাল কিনা; এই গলিটি বাম দিকে যেতে পারে কি না। আমি পর্বতের কাঠামো শিখতে পেরেছিলাম।

আমার ২০ বছর বয়স পর্যন্ত আমার বাবা-মা আমার আরোহণে সহায়তা করেছিলেন। আমার বাবা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি আমার জীবন হতে চলেছে, তখন তিনি আমাকে থামানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবং আমি যখন ১৯৭৮ সালে এভারেস্টে অক্সিজেন ছাড়াই আরোহণ করতে যাই, তিনি স্থানীয় মদের দোকানে বসতেন এবং বলতেন যে আমি পাগল। যখন আমি সফল হই, তখন তিনি বলেছিলেন: ‘আমি জানতাম যে সে এটি করবে!’

আমার বাবা আমার ভাই গুন্থারের মৃত্যুর জন্য আমাকে দোষারোপ করেন, তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে না পারার জন্য। ১৯৭০ সালে ৮,০০০ মিটারের উপরে ১৪ টি পর্বতশৃঙ্গের একটি, নাঙ্গা পর্বতের শীর্ষ থেকে নেমে আসার সময় সে একটি হিমবাহধ্বস এ মারা যায়। গুন্থার ও আমি একসাথে অনেক কিছু করেছি। আমার বাবার পক্ষে বোঝা মুশকিল যে উপরটা কী রকম ছিল।

নাঙ্গা পর্বতে আমি আমার নিজের মৃত্যুর বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিলাম। আমি কয়েকদিন ধরে কিছু খাওয়া বা পানি পান করতে পারিনি, আমি হ্যালুসিনেট করছিলাম, আমার পায়ের আঙুলগুলি ফ্রস্টবাইটে কালো হয়ে গিয়েছিল এবং আমার ভাই হিমবাহধ্বস এ হারিয়ে গিয়েছিল।

নাঙ্গা পর্বতে আমি যখন পায়ের সাতটি আঙ্গুল এবং আমার হাতের আঙ্গুলের কিছু অংশ হারাই, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি কখনই দুর্দান্ত শৈলারোহী (Rock Climber) হতে পারব না। তাই আমি অতি উচ্চতায় (High-Altitude) আরোহণে দক্ষতা অর্জন করি। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি খেলা। আমি এটির জন্য ১৫ বছরের একটি গভীর আসক্তি গড়ে তুলি এবং সম্ভবত কিছুটা সংকীর্ণমনা হয়ে পরি আমার ৮,০০০ মিটার চূড়ায় আরোহণের আকাঙ্ক্ষায়। আংশিকভাবে এটি অবশ্যই আমার দোষ যে ৮,০০০ মিটার চূড়াগুলি আজ বিশেষ কিছু। সত্যি কথা বলতে কি, এগুলি বিশেষ কিছু নয়।

আমার ভাই মারা যাওয়ার পর আমার সুস্থ হতে এক বছর সময় লাগে, তবে আমি জানতাম যে আমি আরও অনেক কিছু করতে পারি। আমি জানতাম যে স্থায়ী দড়ি (Fixed Rope) ছাড়া এই বড় পাহাড়গুলির যেকোনো একটিতে আরোহণ সম্ভব, তাই আমি ১৯৭৩ সালে নাঙ্গা পর্বত একা আরোহণ করার চেষ্টা করি। তবে সেখানে একা থাকা সম্ভব ছিল না, কারও সাথে কথা বলার নেই, নেই অন্য কোন মুখ। এটি কীভাবে করা যায় তা শিখতে আমার অনেক সময় লেগেছে।

অতি উচ্চতায় (High-Altitude) আরোহণ অবশ্যই কষ্টকর, এটা অবশ্যই ভয়ের। আমি এমন কাউকে বিশ্বাস করি না যে বলে যে সবচেয়ে বড় শিখরে আরোহণে অনেক আনন্দ আছে। এটি বিপজ্জনক, বিশেষ করে যদি শেরপা বা স্থায়ী দড়ি (Fixed Rope) এবং ক্যাম্প না থাকে। আপনি যদি একটি ভুল করেন, তবে আপনি মারা যাবেন।

আমি প্রথম ব্যক্তি যে পরিপূরক অক্সিজেন (Supplementary Oxygen) ছাড়াই বিশ্বের ১৪ টি উঁচু চূড়ায় আরোহণ করেছি, তবে আমি কখনই জিজ্ঞাসা করিনি আমি কতটা উঁচুতে যাব, ঠিক কীভাবে আমি এটা করব। পর্বতারোহণ আমার কাছে খেলাধুলার থেকেও একটি শিল্প বলে মনে হয়। একটি পাহাড়ের নান্দনিকতা আমাকে চালিত করে। একটি রুটের রেখা, আরোহণের স্টাইল। এটা সৃজনশীল।

বাচ্চাদের তাদের নিজস্ব উপায় খুঁজতে হবে। আমার নিজস্ব উপায় আমার বাচ্চাদের জন্য ভুল। তারা আরোহণ করে, তবে আমি তাদের এটা করতে বাধ্য করি না।

আমি গ্রিন পার্টির জন্য এমইপি (Member of the European Parliament) নির্বাচিত হয়েছিলাম। রাজনীতি এবং পর্বতারোহণ হুবহু বিপরীত। তবে এই দুটিই খেলা। যদি বিশ্বের নেতারা একসাথে একটি পাহাড়ে আরোহণে কয়েক দিন ব্যয় করতে পারতেন তবে পরিস্থিতি আরও ভাল হত।

আমি প্রতিটি নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সাথে সর্বদা একই দৃষ্টিভঙ্গি ধারন করি। আমি নিজেকে জীবনের শেষ অবস্থানে স্থাপন করে পেছনে ফিরে তাকাই। এরপর আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি যে আমি যা করছি তা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিনা।

শ্যাকলটন এন্ডুরেন্স অভিযানটি ছিল গত শতাব্দীর সেরা অ্যাডভেঞ্চার। শ্যাকলটন ব্যর্থ হলেও তিনি তাঁর সাথের সব লোককে বাঁচিয়েছিলেন। এখন আমি ৫৯ এর কাছাকাছি এসেছি, আমি বুঝতে পারি যে ব্যর্থতা সাফল্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি যদি আমার জীবন দেখেন, তবে একটি জিনিস পরিষ্কার। আমি আমার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি, আমার সমস্ত অর্থ এবং আমার সমস্ত সময় দিয়ে একবারে একটি কাজ করেছি। সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভাবে। 

তথ্য https://www.theguardian.com/

ছবি https://mountainplanet.com/