কনরাড আঙ্কারঃ দুর্গমতাকে জয় করা ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক জীবন্ত কিংবদন্তি
আমেরিকান পর্বতারোহী কনরাড আঙ্কার একজন এক্সপ্লোরার, পর্বতারোহী এবং আমেরিকার অন্যতম সেরা অ্যাল্পাইনিস্ট হিসেবে পরিচিত। ক্যারিয়ারের সম্পূর্ণ সময় জুড়ে কনরাড পৃথিবীর সর্বাধিক দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্বতারোহন ও কঠিন কঠিন নতুন রুট স্থাপন করেছেন, গড়েছেন দুর্লভ কীর্তি। তিনি ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর The North Face ক্লাইম্বিং দলের দলনেতা ছিলেন।
 
ব্যক্তিগত জীবন
৫৮ বছর বয়সী অভিজ্ঞ এই পর্বতারোহী ১৯৬২ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। মন্টানার বোজম্যানের বাসিন্দা এই কিংবদন্তী ২০০১ সালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিখ্যাত পর্বতারোহী প্রয়াত এলেক্স লোর বিধবা স্ত্রী জেনিফারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এলেক্স-জেনিফার দম্পতির তিন সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মনে করেন যে একজন বাবা হওয়ার কারণে তিনি আরও সফল পর্বতারোহী হতে পেরেছেন কারণ পারিবারিক সমর্থন তাকে মনোনিবেশ করতে সহায়তা করেছে এবং সফলতার নৈপুণ্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। 
 
পর্বতারোহনের শুরুটা যেভাবে
কনরাড আঙ্কারের দীর্ঘ ৩০ বছরের পর্বতারোহনের বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমেরিকার ৪৩৯২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট রেইনিয়ার আরোহণের মাধ্যমে। সল্টলেক সিটির উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় একটি পর্বতারোহণ সামগ্রীর দোকানে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন তিনি। সেই সময় সেখানে তাঁর প্রথম মেন্টর, প্রয়াত আইকনিক ক্লাইম্বার মগস স্টাম্পের সাথে পরিচয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন কনরাডকে কাঠমিস্ত্রীর কাজও করতে হয়েছে খণ্ডকালীন পেশা হিসেবে। সেখানেই তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু, প্রয়াত এলেক্স লোয়ের সাথে সখ্যতা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি চৌকস এই পর্বতারোহীকে। তিনি ও এলেক্স ৯০ এর দশকে হিমালয় এবং এন্টার্কটিকায় স্পীড ক্লাইম্বিংয়ের রেকর্ড স্থাপন করেন।
এলেক্স লো তার প্রজন্মের অন্যতম সেরা পর্বতারোহী এথলেট হিসাবে পরিচিত ছিলেন। পর্বতারোহনের প্রতি কনরাডের অনুপ্রেরণার বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, “কনরাডের জন্য পর্বত হল প্রাকৃতিক ভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটা স্থান। যেখানে তাঁর হৃদস্পন্দন হয় এবং আত্মা অনুগত হয়।’
 
কিংবদন্তীর খোজে কিংবদন্তী
১৯৯৯ সাল। কনরাড আঙ্কার তখন তার পর্বতারোহণ ক্যারিয়ারের শীর্ষে। সে বছর তাঁর এভারেস্ট আরোহণের সময়, ১৯২৪ সালে এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরীর দেহাবশেষ আবিষ্কার করেন। জর্জ ম্যালোরী ও এন্ড্রু আরভাইনের মৃত্যু পর্বতারোহণের অন্যতম রহস্য। আর ম্যালোরীর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া সেই আলোচনায় আবার ঝড় তোলে, যা কনরাডকে অনেক পরিচিতি দিয়েছিল।
 
হার না মানা এক লড়াকু
জর্জ ম্যালরীর দেহাবশেষ আবিষ্কারের বছরেই পৃথিবীর ১৪ তম উচ্চ পর্বত শিশা পাংমার শীর্ষ থেকে স্কী করে নামার উদ্দেশ্যে অভিযানে যান কনরাড, এলেক্স লো ও ডেভিড ব্রিজেস। সেই অভিযানে তুষারধসে কনরাডের ঘনিষ্ট বন্ধু এলেক্স লো এবং ডেভিড ব্রিজেস (দুইবারের মার্কিন জাতীয় প্যারাগ্লাইডিং চ্যাম্পিয়ন, পর্বতারোহী ও অভিযানের ক্যামেরাম্যান ছিলেন) চিরতরে হারিয়ে যান। মারাত্নকভাবে আহত অবস্থায় কোনোরকমে বেঁচে যান কনরাড। প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে শোকে মুষড়ে পড়েন তিনি। হয়তো এইখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো কনরাড আঙ্কারের বর্নিল পর্বতারোহন ক্যারিয়ার। কিন্তু তিনি হার মানেন নি। সুস্থ হয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে আবারো ফিরেছেন পর্বতে।
২০১৬ সাল। প্রয়াত অস্ট্রিয়ান পর্বতারোহী ডেভিড লামাকে সাথে নিয়ে নেপাল এবং তিব্বতের সীমান্তে ৬৯০৭ মিটার উচ্চতার অনারোহীত পর্বত ‘লুনাগ রি’ অভিযানের সময় ২০,০০০ ফিট উচ্চতায় হার্ট অ্যাটাকের স্বীকার হন কনরাড। এইবারও থেমে যাননি লড়াকু এই পর্বতারোহী। ঠিক পরের বছর, ২০১৭ সালে তিনি জিমি চিন, অ্যালেক্স হেনল্ড, আনা পাফাফ, চেডার রাইট, এবং সাভানা কামিন্সকে নিয়ে গঠিত The North Face দলের সাথে অ্যান্টার্কটিকার Queen Maud Land এর Wolf’s Jaw Massif অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঐ মহাদেশে এটি তাঁর দ্বাদশ অভিযান ছিল। তিনি এই ম্যাসিফের সর্বোচ্চ চূড়া Ulvetanna(৯৬১৬ ফিট)-তে জিমি চিনকে নিয়ে একটি নতুন রুট স্থাপন করেন।
 
কনরাড আঙ্কার যেখানে সেরা

কিংবদন্তীরা সবার চেয়ে একটু আলাদা হন, কনরাড ও এর ব্যতিক্রম নন। উচ্চতার চেয়ে দুর্গমতার আকর্ষণই তাকে বেশী মোহিত করেছিলো। হিমালয়, আল্পস, সেভেন সামিট বা আট হাজারী পর্বত ও অন্যান্য পর্বতমালার চাইতে এন্টার্কটিকার দুর্গম সব পর্বতই তাকে অনেক বেশী আকর্ষণ করতো, তাই তিনি ঐ অঞ্চলে বেশকিছু প্রথম আরোহনের রেকর্ড গড়েন ও নিত্য নতুন রুট তৈরীতে মনোনিবেশ করেন। দুর্গম পথে অধরা পর্বত আরোহনই যেন তার নেশা ও ধ্যানজ্ঞানে পরিনত হয়, আর এখানেই কনরাডের সতন্ত্রতা, যা তার পর্বতারোহন ক্যারিয়ারকে করেছে অনন্য, দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।

২০১১ সালে কনরাড, জিমি চিন এবং রেনান ওজটুর্কের সাথে ভারতের মেরু পর্বতের সবচেয়ে দুর্গম সামিট রুট ও শীর্ষ বিন্দু শার্ক’স ফিনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রথম আরোহণ করেন। সানড্যান্স- বিজয়ী প্রামান্য তথ্যচিত্র ‘মেরু’ এই অভিযানকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়।

কনরাড তিনবার এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করেছেন, এর মধ্যে ২০১২ সালে আমেরিকানদের প্রথম এভারেস্ট আরোহণের
৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সাথে অভিযানও অন্তর্ভুক্ত।

 
সামাজিক অবদান
নেপালে অভিযানের ২৫ বছরেরও বেশি সময়কালে কনরাড এবং তাঁর স্ত্রী জেনিফার লো-আঙ্কার শেরপাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং নেপালে খুম্বু ক্লাইম্বিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা অতি উচ্চতার পেশাজীবীদের বিভিন্ন ধরণের সুরক্ষা প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
 
কনরাড তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক নিবন্ধ ও বই লিখেছেন, তৈরি করেছেন প্রামান্য তথ্যচিত্র। আমেরিকান আল্পাইন ক্লাব থেকে প্রকাশিত ‘আমেরিকান আল্পাইন জার্নাল’ -এ তাঁর লেখা নিবন্ধগুলো হলোঃ
• গাম্বিজ অন জার্নি (Gumbies on Gurney)
• হান্টারস্ নর্থওয়েস্ট ফেস (Hunter’s Northwest Face)
• উইথ ইউ ইন স্পিরিট (With You in Spirit)
 
জর্জ ম্যালরীর দেহাবশেষ আবিষ্কার নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই-
• দ্যা লস্ট এক্সপ্লোরার: ফাইন্ডিং মেলরী অন মাউন্ট এভারেস্ট (The Lost Explorer: Finding Mallory on Mt. Everest)

কনরাডের উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র –

• মেরু (Meru)
• লুনাগ রি (Lunag Ri)
• দা এন্ডলেস নট (The Endless Knot)
• লাইট অফ দ্যা হিমালয়া (Light of the Himalaya)
• দ্যা ওয়াইল্ডেস্ট ড্রিম (The Wildest Dream)
 
কনরাডের অর্জন সমূহ-
কনরাড আঙ্কার তাঁর বনার্ঢ্য পর্বতারোহণ ক্যারিয়ারে গড়েছেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী রেকর্ড। আলাস্কা, পাতাগুনিয়া ও এন্টার্টিকা অঞ্চলে ৭ টি পর্বতে প্রথম আরোহী ও হিমালয়ের মেরু পর্বতের শার্ক ফিন চূড়ায় প্রথম আরোহনের রেকর্ডের মালিক কিংবদন্তি এই পর্বতারোহীর উল্লেখযোগ্য অর্জন সমূহঃ
 
১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১২ – তিনবার এভারেস্ট আরোহণ (একবার অক্সিজেন ছাড়া এবং একবার ফ্রি ক্লাইম্বিং)
২০০৫ – দক্ষিণপশ্চিম রিজ, চোলাতসে, খুম্বু অঞ্চল, নেপাল
২০০১ – এন্টার্কটিকা এলসওয়ার্থের ভিনসন ম্যাসিফ আরোহন ও নতুন রুট স্থাপন
২০০২ – তিব্বতের প্রত্যন্ত চাংটাং মালভূমিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অভিযান  
১৯৯৯ – শীশাপাংমা আমেরিকান স্কি অভিযান
১৯৯৭ – কন্টিনেন্টাল ড্রিফট, এল ক্যাপিটান ওয়াল (প্রথম আরোহণ)
১৯৯৭ – কারাকোরামের টেসেরিং মোসোং, দ্বিতীয় লাতোক (প্রথম আরোহণ)
১৯৯৭ – রেকেনিভেন পিক, কুইন মাউড ল্যান্ড, এ্যান্টার্কটিকা, (প্রথম আরোহণ)
১৯৯৭ – উত্তরপশ্চিম দিক দিয়ে পিক লরেটান, ইলসওয়ার্থ পর্বতমালা, এ্যান্টার্কটিকা (একা) 
১৯৯৪ – ব্যাডল্যান্ডস দক্ষিণপূর্ব দিক দিয়ে টরে এগার, প্যাতাগনিয়া (প্রথম আরোহণ)
১৯৯২ – শুনস বাট্রেস, রেড আর্চ মাউন্টেন, জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রথম আরোহণ)
১৯৯২ – ইস্ট বাট্রেস, মধ্য ট্রিপল পিক, কিচাতনা স্পিয়ার্স, আলাস্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (দ্বিতীয় আরোহণ)
১৯৯০ – রোডিও কুইন, স্ট্রেইকড ওয়াল, জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক, ইউটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রথম আরোহণ)
১৯৮৯ – উত্তরপশ্চিম দিক দিয়ে মাউন্ট হান্টার, আলাস্কা রেঞ্জ, আলাস্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রথম আরোহণ)
১৯৭৮ – দক্ষিণপূর্ব দিক দিয়ে গুর্নি পীক, আলাস্কা রেঞ্জ, আলাস্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রথম আরোহণ)
 
কনরাড এযাবৎ বিভিন্ন ধরণের সম্মাননা পুরুস্কার পেয়েছেন এবং ‘”Protect Our Winters” ,‘আমেরিকান হিমালয়ান ফাউন্ডেশন’, এবং ‘অ্যালেক্স লো চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন’বোর্ডর সদস্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন প্রজম্মের অনুপ্রেরণা, অভিজ্ঞ এই পর্বতারোহী তার সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ পর্বতারোহনের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তার উজ্জল দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে।