এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি (preparation for Everest expedition)!
পর্বতারোহণ পদচারণার শুরুতে বা আগে অনেকেই স্বপ্ন দেখেন এভারেস্ট এর চূড়ায় যাবেন! অনেকেই আমার কাছে পথঘাট জানার পরামর্শ চান। ভাল লাগে, আপনাদের আগ্রহ দেখে। আপনাদের জন্যই আমার এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি (preparation for Everest expedition) বিষয়ক লেখা।
প্রথমেই জেনে নেই এভারেস্ট কি?
হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হল এভারেস্ট। নেপাল ও তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার। নেপালে সাগরমাথা আর তিব্বতে চোমোলাংমা নামেও পরিচিত।
প্রায় প্রতিটা পর্বতারোহীর মনের কোন এক গভীরে এই এভারেস্টের শিখরকে স্পর্শ করার স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। আমি আবার বলছি ‘স্পর্শ’! দয়া করে কোন পাহাড় বা পর্বতে সফল ভাবে অভিযান করে ফিরে আসার পর বলবেন না যে, মেরে আসলাম, দিয়ে আসলাম বা জয় করে আসলাম! এর কোনটাই আপনি, আমি বা কারো পক্ষে সম্ভব না। আমরা শুধু স্পর্শ করে ফিরে আসতে পারি।
এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করাটা খুব সহজ নয়। এর জন্য নিজেকে বেশ কয়েকটি দিক থেকে প্রস্তুত করতে হয়। আসুন দেখে নেই আমাদের কোন কোন বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।
▶ মানসিক শক্তি
▶ শারীরিক সক্ষমতা
▶ পরিবেশের সাথে শরীরকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা
▶ অভিজ্ঞতা অর্জন এবং
▶ অর্থের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা যা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
প্রথমেই আসে মানসিক শক্তি–
যখনই আপনি এমন একটি অভিযান করবেন বলে ভাবনা শুরু করেছেন তখন থেকেই আপনার মানসিক শক্তি কাজ করতে শুরু করবে। কারণ একটু পড়াশোনা করলেই দেখবেন, এভারেস্ট হোক বা অন্য কোন পর্বত, আপনার শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতেই হবে। যদি আপনি নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তাহলে বেশ অনেকটা সুবিধা পাবেন। আর যদি শরীর চর্চার অভ্যাস না থাকে, তাহলে নিয়মিত শরীরচর্চা করার চেষ্টা আপনার মানসিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করবে। প্রথম ধাপে নিয়মিত সকাল সকাল ঘুমকে পরাজিত করে শরীরচর্চা করতে পারলেই বুঝতে পারবেন, প্রথম ধাক্কা উতরে গেছেন।
শারীরিক সক্ষমতা-
মনকে প্রস্তুত করার পরেই শরীরকে প্রস্তুত করতে হবে। পর্বতারোহণ কোন প্রমোদ ভ্রমণ নয়। এর পথটা সাধারণত একটু কঠিনই হয়ে থাকে। ছবিতে পথ দেখে অনেক সময় সহজ মনে হতে পারে, আসল কঠিন বিষয় হচ্ছে অতি উচ্চতার প্রতিকূল পরিবেশ। সমতলে যেভাবে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস এর কার্যক্রম চালাতে পারি,অতি উচ্চতায় সেটা করতে পারি না। শরীরকে সচল রাখতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারি না। এই অবস্থায় শরীরকে সচল রাখতেই শরীরচর্চা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত দৌড়, কার্ডিও, ইওগা, প্রানায়ামা, মেডিটেশন এই সকল চর্চা অতি উচ্চতায় আপনার শরীরকে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। বিস্তারিত শরীরচর্চা বিষয়ক লেখাতে পেয়ে যাবেন।
প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতি –
এমনও ঘটনা আছে ইতিহাসে, এভারেস্ট সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা না নিয়েও এভারেস্ট অভিযানে যায় এবং সফল হয়েও ফিরে আসে! কিন্তু এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা, যা একটি উদাহরণ হিসেবে ধরাটা বোকামীই হবে। তাহলে আপনি কিভাবে প্রস্তুতি নিবেন?
পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নেয়ার সেরা পথ হচ্ছে আপনাকে পর্বতে যেতে হবে। যত বেশী যাবেন ততবেশী শিখবেন এবং অভ্যস্ত হবেন। নিয়মিত অভিযান করলে শিখতে পারবেন এবং আপনার শরীরকে প্রস্তুত করতে পারবেন। এভারেস্ট অভিযানের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নেয়ার তেমন প্রয়োজন না হলেও পর্বতারোহী হতে হলে সাধারণ পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ অবশ্যই নেয়া উচিত। প্রশিক্ষণ বিষয়ক লেখায় বিস্তারিত জানতে পারবেন।
প্রস্তুতি হলো প্রশিক্ষণ ও হলো, এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থ। অনেক প্রতিভা সম্পন্ন পর্বতারোহীর স্বপ্ন এই একটা জায়গাতেই থমকে যায়! নিজ ব্যবস্থায় পুরো অর্থের যোগান দেয়াটা অনেক কঠিন। এভারেস্ট অভিযানের জন্য একজনের কমবেশি ৮০ লাখ থেকে ১.৫ কোটি টাকা লেগে যেতে পারে! তাই আমাদের বিভিন্ন পৃষ্টপোষকতা খুজঁতে হয়। এত বড় একটা অংকের সমাধান পৃষ্টপোষকতা ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। শুধু এভারেস্টের জন্য পৃষ্টপোষকতাই যথেষ্ট নয়। এভারেস্ট অভিযানের আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে আপনার কমপক্ষে ৫/৬ টা পর্বত অভিযান প্রয়োজন। প্রথমেই ৫০০০/৬০০০ মিটার পর্বতে অভিযান করে নিজেকে খাপ খাওতে হবে। ২/৩ টা ৬০০০ মিটারের অভিজ্ঞতার পর ৭০০০ মিটারের এর অভিজ্ঞতা নিতে হবে একটা অথবা দুইটা। এরপরে আপনি নিজের উপর আস্থা আনতে পারলে এভারেস্ট অথবা ৮০০০ মিটারের পর্বতে অভিযান করতে পারেন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন এভারেস্ট এর আগে আরো ৫/৬ টা অভিযানের অর্থের যোগান দিতে হবে, যার প্রতিটা অভিযান ক্ষেত্র বিশেষে ১ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ৫/১০ লক্ষ টাকাও হতে পারে।
এতো কিছুর পরেও যে সফল ভাবে অভিযান সম্পন্ন হবে, তা হলফ করে কউ বলতে পারবে না। কারণ অতি উচ্চতায় অনেক কিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয় না। একটি অভিযান ব্যর্থ হতে একটি ছোট্ট ভুলই যথেষ্ট। সেই ভুলের জন্য জীবনও চলে যেতে পারে! যত উপরে উঠবেন, ঝুঁকির পরিমান ততই বাড়তে থাকবে। এই সকল ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজন অতি উচ্চতায় অভিজ্ঞতা। এভারেস্টে যাওয়ার প্রস্তুতি আপনার যত পরিপক্ক হবে, অভিজ্ঞতাও তত বেশি হবে আর জীবন নিয়ে ফিরে আসার সুযোগটাও বেশি থাকবে।
মনে রাখবেন চূড়ায় আরোহণটাই সফলতা নয়, অভিযান সফল করতে হলে আপনাকে জীবন নিয়ে নিচে নেমে আসতে হবে।
বিখ্যাত পর্বতারোহী এড ভিশ্চারস বলেছেন, “Getting to the top is optional. Getting down is mandatory.’’ তাই যদি আপনি এভারেস্ট এর শিখরে নিজেকে দেখতে চান তবে কিছু প্রস্তুতি আপনাকে নিতেই হবে। যদি আপনি অভিজ্ঞ পর্বতারোহী না হয়ে থাকেন, তবে আমার অনুরোধ থাকবে নিচের এই প্রস্তুতি গুলো নিয়ে তারপরে এভারেস্ট অভিযানে যাবেন।
◾নিজের শরীরকে পরিপক্ক করতে হবে।
◾একটি টেকনিক্যাল মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করা অথবা অভিজ্ঞ পর্বতারোহীর কাছ থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অনুশীলন।
◾৩/৪ টি অতি উচ্চতায় অভিযান। ভাল হয় যদি ৬০০০+মিটার/২০০০০+ফিট উচ্চতায় কোন পর্বতে অভিযান করতে পারেন।
◾অন্তত একটি অতি উচ্চতা সম্পন্ন পর্বতে অভিযান, যেমন লাকপা-রী, আকঙ্কাগুয়া অথবা ৭০০০+মিটার/২২০০০+ ফিটের কোন পর্বতে অভিযান।
◾একটি ৮০০০মিটারের পর্বতে অভিযান এর অভিজ্ঞতা থাকলে ভাল।
এগুলো সফল ভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আমার মতে আপনি এভারেস্টের জন্য প্রস্তুত হবেন। অনেকেই মনে করতে পারে এটা প্রস্তুতির জন্য অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে! প্রস্তুতি যত ভাল হবে, অভিযান ততই সহজ হবে। আপনাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। অতি উচ্চতায় কত দ্রুত আপনার শরীর মানিয়ে নিচ্ছে, অতি উচ্চতায় কেমন কাজ করছে আপনার শরীর এবং মানসিক অবস্থা? ৬০০০মিটারের উচ্চতায় আপনি কেমন ক্লাইম্বিং করছেন! পরিবেশ পরিস্থিতি কেমন এবং কিভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিবেশে আপনি খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন কিনা ইত্যাদি। স্বল্প সময়ে বা অভিযানে যা ঠিক মত অনুধাবন করা সম্ভব না।
আর এড ভিশ্চারস আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন “No shortcuts to the top”. আশা করি বুঝতে পেরেছেন। যারা মাউন্ট এভারেস্টের শিখর ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছেন, এই লিখাটা তাদের কিছুটা হলেও উপকারে আসবে।
সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধারণামূলক লেখা, ধন্যবাদ।
Thank you so much Rope4 for information
Thanks very much for your comment.
Thanks Mr. Mir Shamsul Alam Baboo for your appreciative comment, this means a lot to Rope4!