সোনাদিয়ায় ক্যাম্পিং, ভ্রমণের জন্য আমরা অনেকেই চোখ বন্ধ করে সাগরকে বেছে নেই। সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার, কুয়াকাটা এবং সেইন্টমারটিন্স আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকল রকমের ট্যুরিস্ট এই সকল পর্যটন এলাকায় ভ্রমণ করেন। মাঝে মাঝে মানুষের সংখ্যা এতোটাই বেশী থাকে যে প্রকৃতি দেখতে এসেছি নাকি মানুষ সেটা নিয়েই বিভ্রান্তে পরে যাই। তাই অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা বেঁছে নিচ্ছে আশেপাশের কিছু নির্জন দ্বীপ। যার মধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপ অনেকেরই পছন্দের তালিকায় আছে।
 
সোনাদিয়া দ্বীপ, বলতে গেলে এই দ্বীপ দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত তাই দ্বীপ বলা যাবে কিনা সেটা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। সোনাদিয়ায় ক্যাম্পিং করতে দুটি পথে যাওয়া যেতে পারে। একটা একটু সময় সাপেক্ষ আর আরেকটি দ্রুত ও আরামদায়ক। সময় সাপেক্ষ হলেও সেই পথে রোমাঞ্চ একটু বেশিই হবে। খরচ এর দিক থেকেও অনেকের কাছে পছন্দের হতে পারে। ঢাকা থেকে বাস যোগে চকরিয়া নামতে হবে, সেখান থেকে লোকাল ট্রান্সপোরটে মহেশখালী আসতে পারেন এবং মহেশখালী থেকে ঘটীভাঙ্গা ব্রীজের সামনে অটো করে আসতে হবে অথবা চকরিয়া থেকে সরাসরি ঘটিভাঙ্গা অটো নিয়ে নিতে পারেন সেক্ষেত্রে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা নিতে পারে। ঘটিভাঙ্গা থেকে সোনাদিয়া আপনি চাইলে হেটেও যেতে পারেন অথবা ট্রলারেও যেতে পারেন। জোয়ার ভাটাকে কেন্দ্র করে লোকাল ট্রলার সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ২ টার মধ্যে যাওয়া আসা করে। সেখানে ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা জন প্রতি আর হেঁটে গেলে এভারেজ সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। এই হচ্ছে সময় সাপেক্ষ পথ। অন্যটি কক্সবাজার চলে আসবেন। সেখানে এয়ারপোর্ট রোডের পাশে কয়েকটী ঘাট আছে যেখান থেকে মহেশখালী যাওয়ার স্পীড বোট অথবা ট্রলার পাওয়া যায়, সেখানে কথা বলে চলে যেতে পারেন সোনাদিয়া পর্যন্ত। সোনাদিয়ায় সরাসরি কোন লোকাল ট্রলার নাই। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ করে নিতে হবে। রিজার্ভ ভাড়া যদি দিনে যেয়ে দিনে চলে আসতে চান তবে ৪০০০ এর আশেপাশে দাম হাঁকাবে। আর যদি একদিনে যেয়ে পরেরদিন ফিরে আসেন তবে ৬০০০ টাকা চাইবে।
 
Rope4 Adventure Club এর আয়োজনে আমরা ১০ জনের একটি দল কিছুদিন আগেই ক্যাম্প করে আসলাম সোনাদিয়া থেকে। চমৎকার পরিবেশ এবং একেবারেই কোলাহলহীন একটা সমুদ্র সৈকত! মনে হচ্ছিল আমরা ১০ জন ছাড়া আর কোন মানুষ মহে হয় এই পৃথিবীতে নেই। বিসাল নীল সাগর, পরিষ্কার বিস্তীর্ণ সৈকত এবং এর পাশে ঝাউ বনের রাজত্ব। সব মিলিয়ে এই রাজ্য যেন একান্তই আমাদের। সাগরের পাশে একান্তই নিজের সাথে সময় কাটাতে চাইলে এর থেকে ভাল কোন স্থান আমি খুব কমই দেখেছি।
 
মুলত সোনাদিয়ায় ক্যাম্পিং করতে, দু’দিন নির্জন এই সোনাদিয়ার সৈকতে নিজেদের মত সময় কাটাতে এবং কিছু বীচ এক্টিভিটি করতেই আমাদের সোনাদিয়ায় যাওয়া। কক্সবাজার থেকে কোস্ট গার্ড এর ঘাট থেকে স্পীড বোটে করে চলে গেলাম সোনাদিয়া। ঘাটে এসে দেখি এখনও জোয়ারে পানি এসে হাজির হয় নাই। ঘাট পর্যন্ত তাই স্পীডবোট পোছবে না। কি আর করার জোয়ারে অপেক্ষা না করে সবাই নেমে পড়লাম প্রায় হাটু সমান কাদায়। সোনাদিয়ায় ক্যাম্পিং করতে এসে, এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল রোমাঞ্চ। গিয়াসউদ্দিন, ছিল আমাদের স্থানীয় আয়োজক, একটু বলে নেই, সোনাদিয়ার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস সাগরে মাছ। তার পাশাপাশি ভিন্ন কিছু রোজগারে উৎস হিসেবে ইউ এস এইড এর অর্থায়নে ক্রেইল প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের বেশ কিছু উন্নত মানের তাবু দেয়া হয় সোনাদিয়ায় ক্যাম্পিং পরিচালনা করার জন্য। যা পর্যটকরা চাইলে তাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে রাতে সাগর পারে ক্যাম্প করতে পারে।
 
 

নিজেরাই নিজেদের ক্যাম্প খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তৈরী করে নিলাম। ঝাউবনে ঘেরা চমৎকার একটি পরিবেশে তৈরী হল আমাদের ক্যাম্প। যার সামনে সৈকত ও সাগর ছাড়া আর কেউ নেই। শুরু হয়ে গেল ক্যাম্পিং। কথা ছিল বেশ অনেকগুলো এক্টিভিটি করবো এই ক্যাম্পে, কিন্তু এখানের প্রকৃতিটাই এমন যে আপনাকে একটি শান্ত করে দিবে। মোহিত করা রাখবে পুরোটা সময়। মনে হবে যে জীবন্টা এখানে এসেই কেমন যেন থেমে গেছে। তাই সাথে আশা সকলের মনের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এক্টিভিটি শিথিল করা হল। সাথে আনা বেসবল, ফুটবল, ফ্রিসবি ও কায়াক নিয়ে সারাটাদিন কাটিয়ে দিলাম। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে স্থানীয় ওই গিয়াসউদ্দিনের বাসাতেই, দুপুর ৩ টায় খাওয়া শেষ করে গাছে হ্যামক ঝুলিয়ে প্রকৃতির কোলে লেটিয়া পড়লাম সবাই। শীতের দিন সন্ধ্যা খুব তারাতারিই হয়ে যায় তাই ল্যাটানো শেষ করে রাতে ক্যাম্প ফায়ার এবং বার বি কিউ করার জন্য কাঠ জোগার করতে হল। নিজেরাই সেই আয়োজন করলাম। বারবি কিউ এর মসলা ঢাকা থেকেই নিয়ে গিয়েছিলাম। মুরগী মসলায় মেরিনেট করে আমরা ১০ জন বসলাম আড্ডায়।

আড্ডা! হাজারো তারার ছাদের নিচে বসে আড্ডা, গান ও পরিচয়। এই সময়টা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ১০ জনকে একটি দলে পরিনত করে দিল। বের হল একেক জনের ঝুলি থেকে তার জীবনের গল্প। কেউ গানের ভুবনে রাজত্ব করে কেউবা রঙের তুলিতে জীবন রাঙ্গায়, আবার কেউ কেউ ডাব এর গল্পে রাত পার করে দিতে চায়। হ্যা আমাদের ক্যাম্পের একজন তার সারা জীবনে কতবার কিভাবে ডাব চুরি করেছে সেই গল্প নিয়ে রিতিমত উপন্যাস বলা শুরু করেছিল! নিতান্তই জোর করে থাকে থামিয়ে আমরা চলে গেলাম ক্যাম্প ফায়ারের প্রস্তুতি নিতে। ঝাউ কাঠ, অনেক শক্ত এবং ক্যাম্পফায়ার ও কয়লার জন্য ভালই মনে হচ্ছে। মোহাম্মদ হক সাথে করে পেনিস্টোভ ও স্প্রিট নিয়ে এসেছিল চা করে পান করার জন্য। সেই স্প্রিট এর সহায়টায় দ্রুত আগুন জ্বালাতে সক্ষম হলাম এবং বেশ ভাল পরিমানের কয়লা পেয়ে গেলাম তাতেই আমাদের বার বি কিউ প্রস্তুত হয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাইকে নিয়ে গেলাম বিশাল সৈকতের মাঝে। চারিদিক অন্ধকার হওয়াতে আকাশের তারা গুলো স্পস্ট দেখা যাচ্ছিল। তাই আমার আকাস দেখার ক্ষুদ্র জ্ঞানটুকু সকলের সাথে শেয়ার করার শুযোগ হাঁট ছাড়া করলাম না। কালপুরুষ, সপ্তসি, পোল স্টার, ক্যাসিউপিয়া এবং এন্ড্রোমিডা নিয়ে অনেক গল্প শেষ করে প্রথম দিনের সমাপ্ত ঘোষনা করা হল।

 
সকালটা একটু অলসতার সাথে আমন্ত্রন জানালো। মারুফা আপু সকাল সকাল চা বানিয়ে খাওয়া যেন একটু অলসতা কাটে। অলসতা কাটাতে মোহাম্মদ কে সাথে নিয়ে একটা সারভাইবাল সেল্টার করার প্লান করে ফেললাম। আজকের এক্টিভিটি শুরু হয়ে গেল, নেচারাল রিসোর্স দিয়ে কিভাবে শেল্টার বানানো যায় সেটাই সকলকে দেখানো। মোহাম্মদ ও আমি লেগে পড়লাম। এবং মোটামুটি মানের শেল্টার বানাতে সক্ষম হলাম। ঝাউগাছে ডাল ও পাতা দিয়ে সহজেই হয়ে যায় আমাদের শেল্টার। সকালে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে চলে গেলাম সাগর পারে।
 
আজ সারা দিন সাগর পারেই থাকবো এবং বিভিন্ন এক্টিভিটি করবো, সেটাই প্লান। প্রথমেই দুটি দলে ভাগ করে একটি মজাদার দলগত খেলার আয়োজন করা হল, পাস পাস এইম। এরপরে শুরু হয় সাগরের উত্তাল ঢেউ এর সাথে কিভাবে কায়াক নিয়ে টিকে থাকতে হয়ে সেটার প্রাক্টিক্যেল ক্লাস। অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরিধন করে সবাই উত্তাল সাগরে কায়াক চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করাটা ক্যাম্পের অনেকের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে। সোনাদিয়ার সাগর পারের ক্যাম্পে আমাদের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল ৫ বছর বয়সের জেসমির। কিউট একটি ছেলে যে বালু অনেক পছন্দ করে। সৈকত হয়ে যায় তার স্বর্গরাজ্য। তার আম্মু একটি বীচটয় নিয়ে আসে সেটা দিয়েই সে মেতে উঠে বালু উৎসবে। আমরাও কম যাবো কেন? তার সাথে তাল মিলিয়ে শুরু করলাম বালু নিয়ে আকাআকি এভাবেই কাটলো আমাদের দ্বিতীয় দিন।
 
সোনাদিয়া থেকে স্পীড বোটে করে বিদায় নেয়ার আগের দুটো দিনে আমাদের কতটুকু মানুষিক প্রশান্তি দিয়েছে তা বোঝাতে পারবো না এই শব্দের খেলায়। যদি কখনো নিজের সাথে সময় কাটাতে চান তবে এই ধরণের একটা ভ্রমণ অবশ্যই করবেন। যার জন্য সোনাদিয়া একটা চমৎকার লোকেশন। মনে রাখবেন ভ্রমণ করতে গেলে আমরা অনেক কিছু সাথে করে নিয়ে যাই এবং ভ্রমণ শেষে অনেক স্মৃতি সাথে করে নিয়ে আসি। আমাদের অনুরোধ স্মৃতির সাথে সাথে আপনাদের যে অপ্রয়োজনীয় কাগজ পলিথিন নিয়ে আসবেন। যেই সুন্দর প্রকৃতি দেখতে আমরা যাই অন্যদের জন্যও সেই রকমই রেখে আসার চেষ্টা করি এবং ছোট ছোট দলে ভ্রমণ করি। তাহলে যেখানে যাবেন সেই স্থান সম্পরকে একটা সুন্দর ধারণা তৈরী হবে। সোনাদিয়া এখনও তেমন পরিচিত পর্যটন গন্তব্য নয়। যদি এই লিখার জন্য একজনও সেখানে যান এবং সেই স্থান নোংরা করে আসেন, তবে সেই দায়ভার আমাদের উপরই এসে পড়বে। তাই আবার ও বলছি যেখানে যাবে সাথে করে নিজের অপচনশীল আবর্জনা নিয়ে আসবেন। আমাদের দেশ আমাদের প্রকৃতি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।