এক দিনের ঝটিকা ক্যাম্পিং
গাজীপুরে একসাথে কাজ করতে গিয়ে ওরা পরিকল্পনা করে যে সুপ্তর নানাবাড়ি গিয়ে ক্যাম্পিং করা যায়। চূড়ান্ত হোল আমরা সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেই এক দিনের ঝটিকা ক্যাম্পিং করবো। কিন্তু অর্ণবের একটা কাজ এসে গেল কাজি রিসোর্টে, তাই শনি রবি হবে। তাতেও অর্ণব কথা দিয়েও ক্যাম্পে আসতে পাড়ল না, কারণ ওর চাচা হাসপাতালে। পারিবারিক এসব দায়িত্ব পালনে অর্ণব অনেক দক্ষ!
আমরা সকাল সকাল, মানে ১০-৩০ এ একটা উবার এক্সেল করে রওনা করলাম। শান্তা আগের রাতেই চলে এসেছিল। ডাফেল ব্যাগ ভর্তি করে ক্যাম্পিং সব সামগ্রী মাহি আর তৌকির রাতেই গুছিয়ে রেখেছিল। আমি সব ঔষধ, ফ্লস, সান ক্রিম আর সরিষার তেল মনে করে গোছালাম। বয়ামে দুইটা পিঙ্ক ম্যাকারুন ছিল, সুপ্তর জন্য নিয়ে নিলাম। সুপ্ত খুচরো খাবার খুব পছন্দ করে, বাদাম, আচার, মোহিত, কফি, আরও সব পরীক্ষামূলক খাবার। এর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওর আনা আমেরিকানো কফির মিনিপ্যাক দিয়ে, অনেক শখ করে মুখে দিয়েই দেখি, মিষ্টি! চোখ কপালে তুলে যখন ওর দিকে তাকাই, কফিতে থাকা চিনির মতই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সুপ্ত বলল, হ্যাঁ আপু, একটু মিষ্টি… (মাথায় হাত দেওয়া একটা ইমো হবে)।
সুপ্তর জন্য আরও কিছু চকলেট নিলাম, একটা নোটবুকও দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ওজন বিবেচনা করে ভাবলাম, ও আসলে পরে দিব। গাড়ির পেছন ভর্তি আমাদের ব্যাগ, তৌকির সামনে আর আমরা তিনজন পেছনে। মাহিকে আমি আর শান্তা মাঝে দিলাম, যেন ঘুম আসলে দুজনই বালিশ পাই! মাঝে রাস্তার কি যেন একটা সমন্বয় করতে হোল, তারপরও আমরা ১২ টা ৪০ এর দিকেই পৌঁছে যাই। যাবার সময়, শান্তা অর্ণব কে ফোন করে জ্বালাচ্ছিল যে তোমাকে কোথা থেকে তুলব, কথা শুনে মনে হোল ওর আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় আসতে পাড়ল না। সুপ্ত লাইভ লোকেশন দিল, আমরা সহজেই পৌঁছে গেলাম। মূল রাস্তা থেকে সামান্য হেঁটেই গ্রামের ঈদগা মাঠে আমাদের ক্যাম্প সাইট, পাশে দুইটা দালান না থাকলে একদম ঘন বনই মনে হচ্ছিল। তাঁবু পাতার জন্য জায়গা নির্বাচন করা হোল, শুরু হোল ক্যাম্প গোছানো।
আমাদের নর্থ ফেসের যে তাঁবুটা আছে, সেটাতে অনেকগুলো ত্রিকোণ ব্যাগ আছে জিনিস রেখে ঝুলিয়ে রাখার জন্য, শুরু হল এই ব্যাগ দেখতে কীসের মত? কেউ বলল এটা বাচ্চাদের নেংটির মত, কেউ বলল মেয়েদের সাঁতারের পোশাক মত, এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি হোল। সুপ্তর তাঁবু সহ আমাদের তিনটা তাঁবুই বড়, দেখতেও সুন্দর লাগছে। হলুদ, সবুজ আর কমলা মিলে অনেক সুন্দর একটা রঙের মেলা তৈরি হোল…শুরু হয়ে গেল কাঠের একটা তক্তা দিয়ে ক্রিকেট খেলা। সুপ্ত অনেক ব্যস্ত, ছুটোছুটি করছে, কারণ ও কি কি পরিকল্পনা করে রেখেছে, জানি না। একবার পানি, একবার টিস্যু, এভাবে বারবার আসা-যাওয়া করছে। পাশেই ওর নানা বাড়ি, যেখানে নানু, দুই খালা আর এক মামার পরিবার থাকে। আমাদের টয়লেটের ব্যবস্থা ওই বাসাতেই ছিল।
ক্যাম্প গোছানোর মাঝেই সুপ্ত বলল, ঠান্ডা নিয়ে আসি, একটা ক্লেমনের বোতল নিয়ে আসলো। মাহি কোক না দেখে বোকা হোল কারণ মাহি আর সুপ্ত দুজনই পাগলের মত কোক পছন্দ করে, আর সুপ্ত এখন ক্লেমন নিয়ে আসছে। মাহি বোতলের ছিপি খুলল, কোন ফুস শব্দ হল না, মাহি বুঝে গেল, এটা প্রাকৃতিক ঠান্ডা, খেজুরের রস! মনে পরল, আমরা তো রস খেতেই ক্যাম্পে আসছি… সবাই অল্প অল্প করে খেল, আমি একটা মগে সামান্য নিলাম, কারণ ফুসফুসে ইনফেকশনের পর থেকে আমি ঠান্ডা এড়িয়ে চলছি, একটু একটু করে মুখে দিয়ে সময় নিয়ে খাচ্ছি, অনেক মিষ্টি! আমার জীবনে এই তৃতীয় বারের মত খেজুরের রস খাওয়া! প্রথম বার ২০০২ সালে অফিসের পিকনিক গাজীপুরে, তারপর ২০১৬ সালে বেগ ভাইয়ের বাসা ফরিদপুরে, এখন তৃতীয় বার আবার গাজীপুরে, চতুর্থবার হয়ত আবার ফরিদপুরেই হবে যদি বেগ ভাই দাওয়াত দেন! চারটা হ্যামোক বাঁধা হল। সামনের দুটো হ্যামোকে সব সময়ই কেউ না কেউ বসে শুয়ে থাকত।
জানলাম, আমাদের খাবারের দায়িত্ব ওর মামাতো ভাই আশিকের ওপর, যে একজন অনার্স এর ছাত্র, পাশাপাশি রান্নার কাজে আগ্রহ রাখে এবং বিয়েতেও রান্না করেছে! খাবার আসলো, ঠিক বিয়ে বাড়ির মত! আলুভর্তা, ডিম কষা, মুরগী আর গরুর গোশতের রেজালা ধরনের তরকারি, সালাদ আর পাতিল ভর্তি করে ভাত। ২ টা ৪০ এর দিকে আমরা ৬ জন খেতে বসলাম। আশিক, আমি যাকে ভেবেছিলাম একটু ভারী শরীরের হবে কারণ যেহেতু রান্না করতে পছন্দ করে, নিশ্চয়ই খেতেও পছন্দ করবে! কিন্তু আমার ধারণা কে একদম পালটে দিয়ে আশিক নিজেকে একজন পাতলা ছিমছাম শরীরের কিছুটা গম্ভীর ভাবের মুখভঙ্গি এবং চশমার কারণে হালকা একটা ভারী ভাব নিয়ে ডেনিমের প্যান্ট, একটা স্পোর্টস টিশার্ট আর লাল জ্যাকেট পরে হাজির হল। স্বল্পভাষী আশিক প্রতিটা কথাই সময় নিয়ে বলে, অপ্রয়োজনীয় কথা অথবা বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস ওর নেই তা স্পষ্ট বোঝা গেল। বাচ্চা একটা ছেলে, অথচ অনেক ভারী একটা ব্যক্তিত্ব!। ওর সাথে গল্প করে ওর বিয়েতে রান্নার পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে রান্নার কথা জানলাম। গতকাল রাতেই এই মাঠে ২০ জনের খিচুড়ি রান্না করেছে আশিক, যার কিছুটা আমরাও বুঝতে পারলাম পোড়া মাটীর অংশ দেখে।
সবাই অনেক মজা আর তৃপ্তি সহকারে খাবার শেষ করলাম। এরকম একটা খাবারের পর চা না খেলে রীতিমতো পাপ হবে, তাই চায়ের জোগান দিল মাহি। অনেক মজার চা বানানো হল। এর মাঝে শান্তা আর তৌকিরের খুনশুটি লেগেই আছে, ওরা যমজ ভাইবোনের মত কথা কাটাকাটি করতে থাকে সবসময়, কিন্তু পরস্পরের প্রতি যথাযথ সম্মান সহকারে। সুপ্ত সহ ওরা তিনজন দুই হ্যামোকে বসে অনেক কায়দা করে চা খেল! চা খাওয়া শেষ হতেই আসলো আমাদের টোনাটুনি, রিফাত আর ফাতেমা। ওদের দেখলে আমার এত ভালো লাগে বোঝাতে পারবো না! সেইদিনের ছোট্ট ছেলে রিফাত যে বলতো, I don’t trust in marriage”, অথচ দুই বছর ধরে কি সুন্দর আর দায়িত্বশীল ভাবে সংসার করে যাচ্ছে, সাথে বাবা মার ও যথাযথ খেয়াল রাখছে। এর জন্য অবশ্যই ফাতেমা প্রশংসার দাবীদার কারণ, রিফাতকে সংসারী করার পেছনে যে মানুষটা প্রেষণা দিয়েছে সে হোল এই ছোট্ট মেয়ে ফাতেমা। এই ছোট্ট মেয়েটা কিন্তু স্কুটিও চালাতে পারে!
রিফাত ড্রোন নিয়ে এসেছে, বের করে চালানো শুরু করলো, আমরা ড্রোন দিয়ে ছবিও তুললাম। শুরু হল পুরো দমে ক্রিকেট খেলা, এর মাঝেই ব্যাডমিন্টনের জন্য নেট আসলো আর লাইটের ব্যবস্থা হল। আমি আর ফাতেমা সুপ্তর সাথে টয়লেটে গেলাম ওর নানু বাড়িতে, বাসাটা বেশ বড়, ৫ তলার ফাউন্ডেশন করা, এখন একতলাই দাঁড়িয়েছে। ওর নানু অসুস্থ, তাই বাসায় কোন আপ্যায়নের ব্যবস্থা সুপ্ত করতে পারেনি বলে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। একদম আধুনিক ফিটিংস দেওয়া টয়লেট, আমি একটু অবাকই হলাম, কারণ সুপ্ত অনেক বেশি নিম্ন পরিলেখ (low profile) তে থাকে, তাই ওদের পরিবারের অবস্থা বোঝা যায় না। সুপ্ত সবসময়ই চেষ্টা করে যেন ওর কারণে কেউ বিন্দুমাত্রও বিরক্ত না হয়, এই যুগে আমরা এত বেশি ভদ্র মার্জিত মানুষকে সাধারণত গাধা অথবা বোকা বলে থাকি! এই মাঠে স্থানীয় ছেলেরা নিয়মিত ব্যাডমিন্টন, ফুটবল খেলে, আজ আর কেউ এখানে খেলার সুযোগ পাবে না, মাঠ আজকে আমাদের দখলে।
আমরা অনেক ছবি তুলেছি, একটা সময় আমি মাহি কে বললাম, এত কেন ছবি তুলছি আমরা? কোন কার্যক্রম ছাড়া ক্যাম্পে নাকি ছবিই তুলতে হয়! বড় ক্যামেরাটা দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে, কেন জানি না, আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় একটা ওজন মনে হয়! যদি আমিও অনেকবার ক্যামেরাবন্দি হয়েছি। প্রতিটা মুহূর্তে অর্ণবের অভাব বোধ করছি। ম্যাসেজ দিয়ে জানতে চাইলাম আসবে কিনা, জানালো আসতে পারবে না, আমি ওর সাথে একটু রাগ করলাম, আমি আসলে জানি না ওর ওখানে কি অবস্থা… অর্ণব বলল যেহেতু ওর স্থানাপন্ন ব্যক্তি (proxy) রিফাত আসছে, ওর না আসলেও সমস্যা নাই! রিফাত আর অর্ণব যমজ, বছরের একই দিনে একজন পিরোজপুরে আর একজন কুমিল্লায় জন্ম নিয়েছিল, এবং আশ্চর্যভাবে Rope4 এ এসে দেখা হয়েছে!
রাত নয়টার দিকে চিকেন বারবিকিউ এর প্রস্তুতি শুরু হোল। তৌকির এসব ব্যাপারে অনেক আগ্রহ, হাত লাগাল, শান্তাও বসে পড়ল চপিং বোর্ডে গাজর আর ক্যাপ্সিকাম কাটতে, ঠিক রেইন ফরেস্ট ক্যাম্পের কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে শান্তা আমাদের ফ্রাইড নুডুলস, কোলস্ল, সালাদ, আর ডাবের পুডিং বানিয়ে খাইয়েছিল আর বরাবরের মত তৌকির তখনও বারবিকিউ টিমেই ছিল। আর একজনের কথা না মনে করলেই না, সে হল, মুনিম, মিটিমিটি হাসি মুখে সবার রান্নার লবণ ঠিক হয়েছে কিনা দেখার জন্য নিজের স্বেচ্ছাসেবিতা দিয়ে যাচ্ছিল…! আমি লাইটের আলোয় বিভূতিভূষণ কে নিয়ে বসলাম, যেখানে আলভারেজ শংকরকে অভিযানের বিভিন্ন টিপস দিয়ে যাচ্ছে…প্রতি পাতায় রোমাঞ্চ, শেষ পর্যন্ত শংকর হীরের খনি খুঁজে পাবে কিনা…জীবিত অবস্থায় শহরে ফিরতে পারবে কিনা…? মাঝে আমি গরম পানি করে ফ্লাক্স ভরে নিলাম, ফাতেমার জন্যও ওদের নীল ফ্লাক্সে গরম পানি দিলাম। আমাদের ফ্লাক্সে পানি ভরার সময় মনে পরল, নেপালে এটা ছিল নিত্যসঙ্গী।
আগুনের কাজ শুরু হোল, সময় লেগে গেল কারণ কয়লা ছিল না, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে নিতে হল। কিছু আগেই আরেক দফায় আশিকের কেরামতি দেখলাম, রাইস কুকার নিয়ে আসছে, আমি ভাবছি ভেতরে কি হতে পারে? ভাবার অবসান হল, সদ্য তৈরি হওয়া ভাপা আর পাটিসাপটা পিঠা দেখার মাধ্যমে, এই প্রথম এই দুই পিঠায় কিশমিশ পেলাম, অসাধারণ স্বাদের পিঠা গুলো আশিক বানিয়েছে! ছেলেটার গুণাগুণে মুগ্ধ হওয়ার কোন শেষ হচ্ছে না, একজন মানুষ কতটা আগ্রহ থাকলে পিঠা বানানোর মত এই কঠিন কাজ এত সুন্দর করে করতে পারে? পিঠা খেয়েই মনে হল যেন রাতের খাবার হয়ে গেল। আমি বই পড়ছিলাম, সামনেই হ্যামোকে দুলছে শান্তা আর তৌকির, পাশে একটা বড় আম গাছ আছে, আলো আঁধার মিলে এত মায়াবী একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে, আমি ছবি না তুলে পারলাম না। পাশে সেই গতিতে ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে…। সকালে যে খেজুরের রস খাবো সেটার প্রস্তুতিও আমাদের সামনেই করা হোল, গাছ কেটে বোতল বেঁধে দেওয়ার সময় তৌকির ওখানে ছিল। গাছটা আমাদের ক্যাম্পেই ছিল। একদম রাতের দিকে স্থানীয় একজন ব্যাডমিন্টন খেলায় যোগ দিল। আমাদের দলের সবচেয়ে ভাল খেলোয়াড়রাও ওনার কাছে পয়েন্টে হেরে গেল। মাহি আর রিফাত ওনার সাথে খেলা শুরু করার আগেই বলেছিল যে, পিঠা খেয়ে এবার হার খেয়ে আসি…
ঘুম চলে আসলো, তাঁবুতে গেলাম। এই তাঁবুটা আমার অনেক পছন্দের, ২০২১ সালে আইফোন না কিনে এই তাঁবুটা কিনিয়েছিলাম অনেক কায়দা করে REI এর নিউ ইয়র্ক আউটলেট থেকে। সে এক বিরাট গল্প…। এসব চিন্তা করতে করতেই ঘুম…। বারবিকিউ হয়ে যাবার পর মাহি আমাকে ডেকে তুলল, অনেক মজা হয়েছে, সাথে নান রুটি আর সালাদ, গাজর ভাঁজা, ক্যাপ্সিকামের সাসলিক, যা নারকেল পাতার কাঠি দিয়ে বানানো হয়েছে। বারবিকিউ দলের শুরু থেকে ছিল, আশিক, তৌকির, সুপ্ত, মোটামুটি সবাই হাত দিয়েছে, এমনকি ফাতেমা, হয়ে যাওয়া টুকরো গুলো ধরে বসে ছিল, আর রিফাত একটু করে ছিঁড়ে খেয়ে দেখছিলো যে কেমন হয়েছে… এরা সবাই এই দলের অংশ। তাই আলাদাভাবে কারো প্রশংসা করার চাইতে মজা হয়েছে বলে নিরাপদে থাকা ভাল মনে করলাম।
সব গোছগাছ করে ঘুমাতে রাত ৩ টার মত বেজে গেল, সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় সুপ্তর কথায়, রিফাত তাঁবু থেকে বের হয়ে ওর স্কুটিটা তাঁবুর পেছনে নিয়ে রাখলো নিরাপত্তার জন্য। বালিশে মাথা দিতেই নাই, ঘুমের দেশে। মনে হল পরক্ষনেই সুপ্ত সবাইকে ডাকছে, সবাই উঠেন, টাইমস আপ, আমি মোবাইলে সময় দেখলাম, ৮ টা বাজে, ঠিক কুঝতে পারলাম না কখনকার ৮ টা, সকাল না রাত… যেহেতু রাত ৩ টায় শুয়েছি, তাহলে সকাল ৮ টাই হবে। মনে হোল, ৫ ঘণ্টা ১ সেকেন্ডে চলে গেছে। তাঁবু থেকে বের হলাম। ৫ লিটারের বোতল নিয়ে সুপ্ত আর আশিক দাঁড়িয়ে আছে! ওরা কখন ঘুমালো, কখন উঠলো? শান্তা তাঁবুতে থেকেই অনেক কষ্টে মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে, মনে হছে ও আরেকটু ঘুমাতে চাচ্ছিল। রিফাত বের হয়ে আসলো, ফাতেমা কিছুক্ষন পর বের হোল। মাহি আর তৌকির দুজনে প্রায় ৩ লিটার রস খেয়ে নীল! বাকিটা আমরা সবাই খেলাম। আমি এক মগ নিয়েছিলাম কিন্তু গরম পানি মিশিয়ে খেলাম, সবাই বিরক্ত হোল আমার সাথে কারণ আমি আসল স্বাদ পেলাম না। জানি এটা অনেক মিষ্টি, আমি একটু হালকা করে খেলাম, কি সমস্যা? এ কাজ আমি সবসময়ই করি, চা-কফি বেশি গরম থাকলে পানি মিশিয়ে একটু ঠাণ্ডা করে খাই। সবাই অবশ্য আমাকে খুব অদ্ভুত ভাবে দেখে তখন! রিফাত খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রোন চালাচ্ছে, আমাদের একটু সরে বসতে বলল ভালো ফ্রেমের জন্য। শান্তা কিছুক্ষন আমার চুল নাড়াচাড়া করছিল, কি যেন ঢেউয়ের মত করে ক্লিপ লাগিয়ে দিল। ও আমাকে চুল কালার করার ব্যপারেও পরামর্শ দিচ্ছিল, কিন্তু আমি তী আর কোনদিনই চুলে কোন রঙই করবো না।
মাহি ফাতেমাকে বলল, তুমি নাকি খুব ভালো চা বানাও, এটা শুনেই ফাতেমা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমতা আমতা করছে, রিফাত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আগে বানাও তার পর বোঝা যাবে ভাল, না খারাপ! ও মেস্টিনে সব একসাথে মিশিয়ে নাড়ছে, আমি খেয়াল করলাম এখনও চুলাই ধরানো হয়নি, তখনই ফাতেমা কাউকে চুলা ধরিয়ে দিতে বলল, সুপ্ত আগুণ জালিয়ে দিল। আমি ভাবছি বেচারি কি আসলেই চা বানাতে পারে নাকি মাহির কথায় বিপদে পড়ল! চা হাতে আসার পর, আমি সাথে সাথেই আমি রিফাতের রাগ করার কারণ ধরতে পারলাম, ফাতেমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কম! এত সুন্দর চায়ের রঙ অভিজ্ঞ হাত ছাড়া আসে না! আর স্বাদের কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করার দরকার নাই। সকালে চাঙ্গা হবার জন্য যেমন চায়ের প্রয়োজন, এই চা তার আদর্শ উদাহরণ।
চা খেয়ে সবাই একটু টয়লেটের উদ্দেশ্যে গেলাম, প্রথমে শান্তা, তারপর আমি, আমার শেষ হতে না হতেই মাহি এমন ভাবে দরজায় ধাক্কা শুরু করল যে আমি ‘পরি কি মরি’ করে বের হয়ে আসলাম, বেচারার দের লিটার রস আর চা মিলে এই অবস্থা… আশিক সহ আমরা ৫ জন সুপ্তদের জায়গাটা একটু ঘুরে দেখলাম, ওদের জমি দেখলাম, সবচেয়ে মজার যে কাঁঠাল, সেই গাছ সহ, লাউ আরও অনেক গাছ দেখলাম। ঠিক হোল যে, যাবার সময় লাউ নিয়ে যাব। একটু সামনের দিকে হাঁটছি, দুইটা বাছুর নিজেদের মধ্যে খেলা করছে, শান্তা বলল, আমি আর অর্ণব, আমি ছবি তুলে রাখলাম, পরে ওদের ছবির সাথে কোলাজ করে দিব। একটা সুন্দর বাঁধানো পুকুর ঘাটে আমরা ছবি তুললাম, পুকুরটা পৌরসভার।
ক্যাম্পে ফিরে আসলাম। গতকালের দুপুরের খাবারের মতই সরপেশ ভরে নাস্তা আসলো। চিতই পিঠা, শুঁটকি ভুনা, গতকালের মুরগী আর গরুর গোশতের তরকারি। মোটামুটি সবাই দুইটা করে পিঠা খেলাম, গতকালের তরকারি গুলো আজ আরও অনেক বেশি মজা হয়ে আছে। সকালে সুপ্তর এক ভাই মাহিদের সাথে ফুটবল খেলছিল, ওকেও অনেক জোড় করে আমাদের সাথে নাস্তা করতে বসালাম। আবার একদফা ভরপেট খাওয়া হোল। সুপ্তকে দুপুরের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে মানা করে দিলাম, কারণ সন্ধ্যার আগে আর কিছু খাওয়া সম্ভব না। নাস্তা খাবার পর চা খাওয়ার ইচ্ছা ছিল, সবাই এতই টুই-টুম্বর ছিল যে কেউ চা বানাতে পাড়ল না। আমি আবার একটু বই নিয়ে বসলাম। সময় ঘনিয়ে আসলো ক্যাম্প গোছানোর। যে উবার করে আমরা এসেছিলাম, উনি ফোন করে জানতে চাইলেন আমরা আজকে ফিরবো কিনা কারণ উনি উত্তরা ছিলেন, ওনাকে আসতে বলে দিল মাহি।
অনেক কড়া রোদ উঠে গেল, আমরা ক্যাম্প গোছানো শেষ করলাম। মানুষ বড় আজব প্রাণী, একটুতেই মায়া হয়ে যায়। এই ১ দিনেই এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে, তবু চলে যেতে হবে…গতদিন আর আজ মিলে অনেক স্থানীয় মানুষ আমাদের পালা করে দেখতে এসেছিল, তবে শুধুই নারী আর শিশুরা। সবার অনেক কৌতূহল ছিল যে আমরা কোন শুটিং করতে এসেছি কিনা, এত ঠান্ডা, রাতে কীভাবে কি করবো, খাব কীভাবে…সবচেয়ে ভাল লেগেছে, একজন মুরুব্বি, উনি আসলেই ওনার দুটো হাঁস ঠিক পিছনেই থাকে। গতকালও উনি এসেছিলেন। এই হাসগুলোর ডানা ঝাপ্টানোর একটা সুন্দর ভিডিও করার জন্য রিফাত ঘণ্টাখানেক এক জায়গায় বসে ছিল। সুপ্তর আতিথিয়তা একদম আবেগি করে ফেলল, ছেলেটা আমাদের সবকিছুর জোগান দিতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে, আমরা কোন কিছুর অভাব বোধ করিনি। আমাদের দেশের মানুষের সংসৃষ্টতা (belongingness) আকৃষ্ট করার মত। খুব সহজেই সবাই আপন করে নিতে পারে। এই ধরনের ক্যাম্প গুলো অনেক সহজেই মানসিক স্বাস্থ্যের খোরাক হয়ে যায়, সবাই মন খুলে কথা বলে, মন খুলে চিৎকার করে, মন খুলে হাসতে পারে। একদম মনমতো ছোট্ট একটি দল নিয়ে এই ধরনের ক্যাম্প আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর অনেক ভাল প্রভাব ফেলে, যার রেশ অনেকদিন পর্যন্ত থাকে, আর যেকোনো কাজেই স্পৃহা যোগায়।
একটা কথা… আপনার ছোট্ট দলটি নির্বাচন করার সময় মাথায় রাখবেন, বন্ধুর সংখ্যা কম হলেও ক্ষতি নেই যদি তা স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত মানুষ দিয়ে বেষ্টিত থাকে, যাদের সাথে আপনি মন খুলে কথা বলতে পারেন, যারা আপনার কথায় বা কাজে ভুল হলে, আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় না তুলে বরং শুধরিয়ে দিবে… আর খুব বেশি জরুরি হোল, আপনি যার শুধরে দেওয়া সাবলীল ভাবে নিতে পারবেন, সে অথবা তাঁরাই হবে আপনার বাছাইকৃত মানসম্মত গন্ডি…!
পুবাইলের এই ছোট্ট ঈদগা মাঠের মায়ায় হয়ত আবার শীঘ্রই যাবো…
Leave A Comment