ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ৪
টেবিলের কোনার আগে মাহি, তারপর সাইফ, তাহমিদ, কামরুল আর ফারজানা বসা। খাওয়া আসলো। সাইফ আর তাহমিদ ফ্রাইড রাইস নিল। এখানে সব হোটেলে ফ্রাইড রাইস আর নুডুলস দেয় প্লেটে পাহাড়ের মত উঁচু করে। তাহমিদ কাল থেকেই খেতে পারছে না, নিজের অবস্থা বুঝতেও চাচ্ছে না, খুব বেশি একগুঁয়ে বাচ্চা! পাশে বসা সাইফ খাবারের দিকে তাকিয়ে দেখেই বলল, মাথার পেছনটা একটু ব্যাথা করছে, এক্লিমাটাইজেশন করে এসেছি, এখন তো ভাল লাগার কথা, কিন্তু হচ্ছে উল্টো। মাহি বলল, খাবার খেয়ে একটু ফ্রেশ হাওয়া খেলে ঠিক হয়ে যাবে, এর কিছুক্ষনের মধ্যেই চোখ উলটে পেছনের দিকে পরে যাচ্ছে… তখন মাহি বাতাসের গতিতে ওর শরীরের প্রতিফলনের মাধ্যমে সাইফকে ধরে ফেলল, তানাহলে ওর মাথাটা জানালার কাঠের সাথে ধাক্কা খেত! মাহি এক হাত সাইফের বুকে অন্য হাত পিঠে, ওকে ঝাঁকি দিয়ে বার বার ওর নাম ডেকে ওকে অজ্ঞান হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে। আমি বেশি চিন্তিত হলে একদম চুপ হয়ে যাই, কিছু বলছি না, শুধু দোয়া পড়ছি আর সবার চোখ সাইফের দিকে। মাহি একজন প্যারামেডিক আর ফার্স্ট এইড রিস্পন্ডার, তাই জানে ওকে কোনোভাবেই ঘুমাতে অথবা অজ্ঞান হতে দেওয়া যাবে না, হাইয়ার হোটেলের একজন বলল, ওর মাথার কাছের জানালা খুলে দিতে, মাহি সাইফের জ্যাকেটের চেইন খুলে আলগা করে দিল, টুপি খুলে দিল, আর ওর গালে বারবার চাপর দিচ্ছিল। আমি জুতা আর মুজা খুলে দিতে বললাম, ওর সারা শরীরে বাতাস দরকার, সুপ্ত আর কামরুল মিলে টেবিলের নিচে যেয়ে সাইফের জুতা মুজা খুলে দিল। ও কিছুটা স্বাভাবিক হল, চোখ সম্পূর্ণ খুলল, ২-৩ সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছে যেন কিছু বুঝতে পারছে না, একটু হেসে বলল, আমি ঠিক আছি, ওর পরিপূর্ণ হাসি দেখে বুঝলাম সম্পূর্ণ ঠিক আছে কারণ আমাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণভাবে কাজ না করলে হাসা যায় না, স্ট্রোক অথবা হ্যমারেজ হলে কেউ কখনোই হাসতে পারে না! মনে পরে গেল আব্বুর কথা, কীভাবে আমি ২০২২ সালে জুলাই ১৮ তারিখে আব্বুকে দেখেই ধরে ফেলেছিলাম যে আব্বুর হ্যমোরেজ হয়েছে, আর শকে চলে যাচ্ছে! এজন্য প্রতিটা মানুষের ফার্স্ট এইড জানাটা অনেক জরুরি! সেদিন যদি শুধু ড্রেসিং করে আব্বুকে বাসায় নিয়ে যেতাম, তাহলে…মনে হলে এখনো আমি কুঁকড়ে যাই!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হয়ে গেল! সবাই অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে, আমি জীবনেও এরকম কোন দৃশ্য দেখিনি, আমি অনেক ভয় পেয়েছি। শুধু একদম স্বাভাবিক আছে মাহি, অর্ণব আর তৌকির! বুঝলাম, ওরা আসলেই দলনেতা! সাইফ ট্রেক করে এসেই ডাইনিং এ এসেছিল, এই রুমটা গরম, ওর কিছুটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার জন্য এমনটা হয়েছে আর খাওয়া দেখে যখন দেখল রুচি নেই, মনে মনে হাই অল্টিচিউড সিকনেসের কথা ভেবে, আর পাশেই তাহমিদ বার বার বলে যাচ্ছে, কি হোল, কেন খেতে পারছি না? এসবে মিলে ওর কিছুটা প্যানিক করে গেছে আর এই চোখ উলটানো দশা হয়েছে। একটু স্বাভাবিক হয়ে সাইফ জানালো চিন্তার কিছু নাই, কারণ ওর আগেও নাকি অজ্ঞান হয়ে যাবার ঘটনা আছে, এটা স্বাভাবিক। ও এটা বলার পর আমি আর মাহি নিজেদের মধ্যে তাকিয়ে ভাববিনিময় করে নিলাম। জানতে চাইলাম, কেন ও এই বড় বিষয়টা রেজিস্ট্রেশন ফর্মে লুকিয়েছে? মাঝেমাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা কোন ভাল কিছু না এবং গুরুতর চিকিৎসাজনিত ব্যাপার! যাইহোক, পরিস্থিতি ঠান্ডা হল। সাথে সাথেই সাইফের বমি আসলো, আর বমিতে ওর সঙ্গ দিল ফারজানা, দুজনেই দৌড় দিয়ে বেসিনে আর বাথরুমে বমি করছে, অন্যরাও প্রায় সব ছুটে গেল ওদের সাথে…যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সবাই।
আমি আর মাহি আলোচনা করলাম যে, ওদের উপরে যাওয়া নিয়ে ও কি ভাবছে? কারণ কেঞ্জিং গোম্ফা ৪০০০ মিটারের নিচে, এতেই এই অবস্থা, তাতে উপরে নিজেদের ও অন্যদের জন্য সমস্যা হতে পারে। মাহি বলল, কালকের দিনটা দেখি কি হয়! আমি এই পরিস্থিতিতে কখনোই পরি নাই, এই টেনশন আমাকে অনেক ধাক্কা দিল, প্রতি বছর মাহি হয়ত ভিন্ন ভিন এইসব ব্যবস্থাপনা করে? একটা খারাপ কিছু হয়ে গেলে কত জবাবদিহিতার মধ্যে পরতে হবে, Rope4 এর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে, কোন একটা ঘটনা ঘটে গেলে, কিছু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন, যারা কোন কিছুই না জেনে বুঝে কথা বলে যায়। যারা আমাদের নিয়ে সমালোচনা করে, আমাদের ভুলগুলো নিয়ে কথা বলে আমাদের শুধরে নেবার সুযোগ করে দেয়, তাদের আমরা আপন ভাবি! তবে কোন কিছুই না জেনে যারা উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়ায় তাদের ভয় করি, কারণ আমাদের ভাল উদ্যোগটা সেইসব অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য বন্ধ করতে চাই না! মনটা একদম শান্ত হয়ে গেল। মাহি আসলেই যোগ্য প্রশিক্ষক, বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বমি শেষ করে ওরা এল। আমরা খাওয়া শেষ করলাম। তাহমিদ আগের খাওয়াটা বাদ দিয়ে শুধু একটা সুপ খেল, ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু স্বীকার করতে চাইছে না! আমি বারবার করে ওকে শুধু গরম পানি দিচ্ছি। আমরা সমতলের মানুষ, এত উচ্চতায় শরীর স্বাভাবিক নাও থাকতে পারে, এটা নিয়ে অস্বস্তি অথবা লজ্জা পাওয়ার কি আছে? হ্যাঁ, সবাই একরকম হবে না, এটাই স্বাভাবিক, তাই বলে আমি কষ্ট পাচ্ছি বলে তো কারো কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি না! সাইফ ওর আগের খাওয়া থেকেই অল্প করে খেল আর ফারজানা আলু নিয়েছিল, অনেক কষ্টে কয়েকটা আলু খেল।
মাহিকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছিল, কারণ সাইফের এই অজ্ঞান হওয়ার বিষয়টা আগে থেকে আমাদের না জানানোর বিষয়টা ওর মনে খোঁচা দিচ্ছে! আমরা অল্প করে আলোচনা করে নিলাম যে সাইফ কে বলবো ওর পরিবারকে এই ঘটনা জানাতে এবং ও যে আরও উচ্চতায় যেতে চাচ্ছে, সে বিষয়টা আর এর সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলো যেন আমাদের সামনেই আলোচনা করে। এই ঘটনা জানার পর যদি সামনে ওর আরও খারাপ কিছু হয় তখন প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমরা দায়বদ্ধ থাকবও যে কেনো পরিবারকে না জানিয়ে আমরা ওকে আরও বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেছি! সবমিলে কেমন যেন একটা পরিবেশ তৈরি হোল…
বাবুর সাথে আমার ২ দিন পর দেখা হল। অর্ণবকে সবার সামনে বাবু ডাকলে ও রেগে যায়! ছেলেটা চুপচাপ, আবেগ প্রকাশ করতে পারে না, শুধু আমার পাসে বসে একবার আমার হাত, একবার আমার জ্যাকেট ধরে বসে থাকলো, এটাই ওর নীরব ভাষা, যে আমাকে মিস করেছে। এই অঞ্চলের হোটেল গুলিতে হাই কমোড আর গরম পানির ব্যবস্থা থাকে, রাতে আমার ফ্লস ব্যবহার করতে হয় নিয়মিত, আর একটা ঔষধ আছে যা মুখ দিয়ে টেনে নিয়ে ভাল করে কুলি করে ফেলতে হয়, তাই রাতে আমার একটু বেশি গরম পানি লাগে। মনে মনে ভাবছি সকালের আলোয় গাঞ্ছাম্পোকে কত সুন্দর লাগবে! লম্বা দিন, লম্বা ক্লান্তি, সাইফের চোখ উল্টানো দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসছে…।
৯ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ৭
পাহাড়ে অতিরিক্ত ঠান্ডায় সকালে ঘুম থেকে ওঠা কোনো সহজ কাজ নয়! মনে হয় যেন শুয়েই থাকি…তবুও উঠতে হয়! অভিযানের সপ্তম দিন, আজকে কোন ব্যাগ গোছাতে হোল না, কারণ আজ আমরা কোথাও যাচ্ছি না। তারপরও কিছু ছোট ছোট জিনিস থাকে যা পকেটে রাখতে হয়, সকালের ঔষধ সাথে রাখতে হয়। পানির বোতল আর সানগ্লাস মনে করে সাথে সাথে রাখতে হয়। এইসব গোছগাছ করে চলে গেলাম প্রিয় জায়গা ডাইনিং এ। একে একে সবাই আসলো, বরাবরের মত নুড়ি সবার পরে, এজন্য কামরুল কে উত্তর দিতে হোল। একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে আমরা এই সমন্বয়গুলো করতাম।
আজ আমরা সারাদিন কেঞ্জিং গোম্ফাতেই থাকবো সবার অভিযোজনের জন্য। তাই সকালে একটু দেরিতে নাশতা করতে গেলাম। মাহির সাথে গতকালই কথা হয়েছিল আমার এখানে থাকা নিয়ে, ও একটু অস্বস্তি বোধ করছিল আমার সাথে কথা বলার সময়। আমি ভাবছিলাম, যদি আমি আজ সারাদিন ভাল থাকি, আমি বেসক্যাম্প পর্যন্ত যাবার বায়না ধরবো। এটাও জানি যে মাহি ছাড়া কেউ রুট চিনে না, যেহেতু মাহি আরও দুইবার এই পথে গিয়েছে, আমাদের কোন গাইড নেই। তৌকির আর অর্ণব অভিজ্ঞ, সাদিক আর নুড়ি নির্ভরযোগ্য ট্রেকার আর কামরুল একদম সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাদিক আর নুড়ি সাথে কামরুলের পার্থক্য হল ‘আবেগ’ কামরুল অনেক বেশি ভাবুক ধরনের। দেখেশুনে নিয়ে যেতে হবে সুপ্ত, ইমন আর সাইফকে। যাইহোক এসব চিন্তা করতে করতেই নাস্তা শেষ হোল আমাদের। গতকাল থেকেই তাহমিদ আর ফারজানা ঠিকমতো খেতে পারছে না, আজ যোগ হল সাইফ। বাকি সবাই ঠিকমতো খেতে পারছে। খাওয়ার ব্যাপারে একদম শুরু থেকেই সামঞ্জস্যতা রেখেছে সাদিক, কামরুল, নুড়ি আর সুপ্ত, এদের খাওয়া নিয়ে কোন ঝামেলা নেই, কি খাবে জানে এবং তাই মজা করে খেতেও পারে।
আজকের আকর্ষণ হোল রক ক্লাইম্বিং। প্রতিবার মিশন হিমালয়া অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ থাকে এই রক ক্লাইম্বিং। এর মাধ্যমে অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা রক ক্লাইম্বিং এর হাতেখড়ি প্রশিক্ষণ পায়। মাহি আর অর্ণব বিস্তারিতভাবে সেশন পরিচালনা করল। সহজ ও কঠিন মিলে অনেকগুলো রকে সবাই অনুশীলন করল। নুড়ি আর সাদিক সবচেয়ে সুন্দরভাবে ক্লাইম্বিং করল। রক ক্লাইম্বিং একটা আর্ট, যারা এটা ভেতর থেকে পছন্দ করে, তাদের শারীরিক গঠন এবং ক্লাইম্বিং এর সময় ভিন্ন একটা তাল (rhythm) থাকে, এদের দেখে বোঝারই উপায় নেই যে এত কষ্টের একটা কাজ করছে। ফারজানা ছাড়া সবাই অনুশীলন করল। এই ধরনের সেশনে সবার আগ্রহটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। কেউ শুধু করার জন্য করে আবার কেউ মন থেকে আগ্রহ নিয়ে ক্লাইম্ব করে। সবশেষে মাহির নজরে বেস্ট ক্লাইম্বার ছিল নুড়ি। সবাই ক্লাইম্বিং এ ব্যস্ত, আমার টয়লেট যাবার দরকার হোল, পাশেই একটা হোটেলে গেলাম, কারণ আমাদের হোটেল একটু দূরে। এই হোটেলে কেউ নাই, ভেতরটা গমগম করছে, নিজের পায়ের শব্দই প্রতিফলত হোল। আমি কয়েকটা রুম ঘুরে দেখলাম, একদম ফাঁকা! টয়লেট থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলাম। বের হওয়ার সময় বাম দিকে অনেক মালপত্র দেখে বুঝলাম, এখনও এর নির্মাণ কাজ চলছে।
ক্লাইম্বিং শেষ করে আমরা আবার ডাইনিং এ আসলাম। গল্প আড্ডা আর খাওয়া মিলে বিকেল করে ফেললাম ডাইনিং এ বসেই। আবার একটু বের হলাম আমরা সবাই, আশপাশটা একটু ঘুরে দেখার জন্য। একটা খোলা প্রান্তরের মত জায়গায় গেলাম, দূরে ল্যাংটাং নদী দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এইতো একটু নিচেই, কিন্তু প্রায় ১৪০ মিটারের মত নিচে। বিকালের আলোয়, আকাশ, পাহাড়ের বিভিন্ন রং মিলে এত সুন্দর একটা পটভূমি দেখা যাচ্ছে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে সময় পার করে দেওয়া যায়। দুজন মেয়েকে দেখলাম, খুব আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলছে। যেহেতু এই আমাদের দলে বেশিরভাগই যোগ্য কুমার (eligible bachelor), সরাসরি না হলেও, সবার দৃষ্টি ছিল সেই দিকেই ছিল! পরে ইমন ওদের ছবি তুলতে সহযোগিতা করেছিল আর এজন্য অনেকবার ওকে পচানো হয়েছিল! আমাদের কয়েকজন গেল নিচে থেকে হেঁটে আসার জন্য, এই ব্যাপারে নুড়ি অনেক বেশি আগ্রহী ছিল। মেয়েটা অনেক প্রাণবন্ত, সবকিছুতেই ওর অনেক উচ্ছ্বাস! সবারই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জুতা না পরে স্যান্ডেল পরে আসার কারণে যাতে পাড়ল না। সেই কয়েকজন গেল আগামীকাল যেখান থেকে ট্রেক শুরু হবে সেইদিকে হেঁটে আসতে। আমরা বাকিরা এমনি অলসভাবে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটলাম, তারপর হোটেলেই ফিরে গেলাম।
আজ রাতে ডাইনিং এ বড় একটা দল ছিল, সবাই নেপালী। আমরা কথা বললাম। ওনারাও ২ জন, ল্যাংটাং যাচ্ছে, সাথে ৪ জন পোর্টার, শুনে একটু অবাক হলাম। উনি বললেন, যে উনি গ্ল্যাসিওলজিস্ট! এই বিষয়ে অনার্স আর মাস্টার্স করেছেন, এখন ইটালিতে PhD করছেন। আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে ওনার কাছে এই বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইলাম, আমি জানতামই না, এরকম কোন বিষয় আছে যা নিয়ে মানুষ পড়ালেখা করে! কত কিছু জানি না! গ্ল্যাসিওলজিস্ট হলেন একজন হিমবাহবিদ বা বরফ বিশেষজ্ঞ। তাঁরাই পৃথিবীকে সতর্ক করেন, যদি এই হিমবাহের বরফগুলো গলতে শুরু করে, তবে সমুদ্র কত ফুট উপরে উঠবে।, তাঁরা এও জানান যে, আলপাইন হিমবাহে সঞ্চিত বরফের ভর জলবায়ুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্ল্যাসিওলজিস্টরা মেরু বরফের ক্যাপ থেকে পর্বত হিমবাহ পর্যন্ত, বরফের সমস্ত দিক অধ্যয়ন করেন। অর্থাৎ, তারা পৃথিবীর সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে যা বরফের সাথে জড়িত। ওনারা তুষার এবং পারমাফ্রস্ট নিয়েও গবেষণা করেন। একজন গ্ল্যাসিওলজিস্ট গবেষণার জন্য বরফ সংগ্রহ করেন, এবং পরীক্ষার জন্য এর নকশা তৈরি করেন। মাঝে মাঝে এই কাজটি আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবী বিজ্ঞান এবং অন্বেষণ ও পৃথিবীর ইতিহাসের গবেষণার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। সর্বোপরি, গ্ল্যাসিওলজি হল একটি আন্তঃবিষয়ক বিজ্ঞান যা ভূপদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ভৌত ভূগোল, জলবায়ুবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, জলবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং বাস্তুবিদ্যাকে একীভূত করে।
সবাই আসলো, মাহি জানালো, ও সবার সাথে বেস ক্যাম্প ও ইয়ালা সামিট বিষয়ক ব্রিফ করতে চায়। সবাই বসলাম, মাহি বিস্তারিত আলোচনা করল, যার যা প্রশ্ন ছিল, করে ফেলল। এবার কাঠগড়া… একে একে ফারজানা আর সাইফ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল যে কেন ওদের বেস ক্যাম্প নিয়ে যাওয়া উচিত? দুজনই আজ সারাদিন কে বিবেচনা করে নিজেদের সমর্থ মনে করল এগিয়ে যাবার জন্য। মাহি এক এক করে সবাইকে নিজ নিজ মতামত দেবার জন্য আহ্বান করলো ওদের যাওয়া সম্পর্কে। সবার মন্তব্য শুরু হওয়ার আগেই মাহি সবাইকে বলল, এরপর একজনের কোন অসুবিধা হলে তা দলের সবাইকে সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে, এমনকি চূড়াও ত্যাগ করতে হতে পারে! একটি দল হয়েই সবাইকে সামিটে যেতে হবে কারণ এখানে রোপ ফিক্সড করে লিড ক্লাইম্বিং এর ব্যাপার আছে, পাশাপাশি, গাইড শুধুই মাহি।
এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত দলনেতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া উচিত! সবাই যার যার পক্ষ থেকে ভাবছে, এত সময় বেড় করে আসছি, এত টাকা খরচ করে আসছি, দেখি না কী হয়…? কিন্তু দলনেতা একজন পাহাড় বিষয়ক অভিজ্ঞ মানুষ। তারপরও আমরা সবাইকে জড়িত করলাম, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে নেবার আগে। সাদিক স্পষ্টভাবে বলেছে, ও ওদের নিয়ে যেতে চায়, যেকোনো পরিস্থিতি ও মেনে নেবে। বাকি সবাই আবেগি মন্তব্যই দিল। শুধু নুড়ি একদমই ওদের আর সামনের দিকে যাওয়াটা সমর্থন করছিল না, এটা ওর চেহারায় স্পষ্ট ছিল! ও একটু সময় নিচ্ছিল উত্তর দিতে, কারণ মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও বাস্তবতা অনেক ভালো বোঝে। এই সময়টা আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগছিলো কারণ মিশন হিমালয়া আমাদের শিক্ষানবিশ প্রোগ্রাম, এখানে এরকম পাহাড় বিষয়ক অনভিজ্ঞ সবার মন্তব্য নিয়ে অভিযানের চূড়ান্ত কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, এটা একটু খাপছাড়া লাগছে। পরেই মনে হল, আমরা অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাসী। সবার মতামত নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি, যেন আমাদের একচেটিয়া কোন ব্যাপার না থাকে, এছাড়া মাহির বিচক্ষণতার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, সবার মতামত নিয়ে মাহি একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমি সবশেষে একটাই কথা সবাইকে বললাম, এখানে সবাই যে যার মত করে পরামর্শ আর মন্তব্য দিয়েছো, কিন্তু বেস ক্যাম্পে যাবার পর দলনেতার কথাই হবে চূড়ান্ত, সবই যেন সেটা মেনে নেয়, সেই অনুরোধ সবাইকে করলাম।
পাশে বসা হিমবাহবিদ নেপালী আপু উনি অনেক মনোযোগ দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ আলোচনাটা শুনেছেন ও দেখেছেন। উনি আমাদের সবার মন্তব্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারটা প্রশংসা করলেন। বললেন, সম্পূর্ণ না হলেও বেশ কিছু কথা উনি বুঝতে পেরেছেন। কারণ নেপালি স্থানীয় ভাষাভাষীরা হলেন খাস নামে পরিচিত এবং তারা পাহাড়ি ইন্দো-আর্য ভাষা ব্যবহার করে যা বাংলার সাথে অনেক মিল। বাঙালি এবং নেপালিদের মধ্যে আরেকটি মিল হল নেওয়ার জাতি, এরা হলেন, মধ্য নেপালের জাতিগতভাবে উচ্চাভিলাষী চেহারার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যাদের দেখতে অদ্ভুতভাবে বাঙালিদের মতো লাগে। নেওয়ারি ভাষার লিপিও দেখতে অনেকটা আকর্ষণীয়ভাবে বাংলা লিপির মতো।
আজকে ট্রেকিং এর কষ্ট ছিল না, কিন্তু দিনশেষে সাইফ সবাইকে ট্রেকিং থেকেও অনেক বেশি ভোল্টেজের ধাক্কা দিয়ে দিল! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হোল, আমি আর তাহমিদ কেঞ্জিং গোম্ফা থাকবো, আমাদের পোর্টার সহ ১২ জন আগামীকাল সকালে ইয়ালা বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা করবে। ৬-৩০ এ নাস্তার সময় ঠিক হোল। এই এতসবের মধ্যে আমি যে বেস ক্যাম্প যাবার চিন্তা করাও পাপ হবে, তা আমার মন বুঝে গেল, কাউকে আর কিছু বললাম না! শুধু অর্ণবকে বললাম, মা আর যেতে পারছি না, ও বলল, তোমাকে কে আসতে বলেছিল, কেনো আসছো তুমি…? আচ্ছা আমি যদি যাবার বায়না ধরি, কি হবে? মাহি অর্ণবের অনেক মানসিক চাপ হবে! আমি চাইনা এই চাপ ওদের উপর আসুক আর এটা মিশন হিমালয়া কে প্রভাবিত করুক। আমি কোনোভাবেই চাইনা, শুধু আমার জন্য এই আয়োজনটাতে সমস্যা হোক! অনেক দিক বিবেচনা করে আমি একদম চেপে গেলাম, যা আসলে সবসময়ই করি…সবদিক বিবেচনা করেই একদিন গোচেলা যাইনি, সেই গোচেলা আমার আজও যাওয়া হোল না…তাতে কি হয়েছে…Rope4 একজন যোগ্য প্রশিক্ষক পেয়েছে, সময়টা কেনা হয়েছিল। আমার শরীরের এই অবস্থা নিয়েও কেঞ্জিং গোম্ফা পর্যন্ত আসতে পেরেছি এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া…
আমি আর মাহি সাইফকে ওর পরিবারের সাথে কথা বলার বিষয়টা নিয়ে কথা বললাম। ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল কারণ ওর বাসার লোক জানতে পাড়লে ওকে আর কোথাও যেতে দিবে না এমনকি এই ইয়ালাও ওর যাওয়া হবে না! ও মাহিকে অনেক অনুরোধ করছিল, যে ওর আর কিছু হবে না…আমরা পরে গেলাম বিবেকের দোদুল্যমানতায়! কি করবো? সাইফ বাচ্চা ছেলে, টাকা জমিয়ে, ছুটি নিয়ে এখানে এসেছে, ওর কাছে সামিট করাটাই মুখ্য! যদিও আমরা রেজিস্ট্রেশন ফর্মে লিখে রেখেছি, যে কোনো অবস্থার জন্য অভিযানকারী নিজেই দায়ভার বহন করবে, তারপরও এই মুহূর্তটা খুবই দোটানার! ওর পারিপার্শ্বিকতা আর মাহির অভিজ্ঞতার বিবেচনায়, সিদ্ধান্ত হোল, ও যাচ্ছে আর আপাতত পরিবার কে কিছু জানাচ্ছে না। বেস ক্যাম্পের জন্য চূড়ান্তভাবে ডাফেল ব্যাগ গোছান হল। নাস্তার জন্য ছিল নুডুলস, স্যুপ, দুই ধরনের কর্ণফ্লেক্স, লাচ্ছা সেমাই। এছাড়া খিচুড়ি মিক্স, তেল, আচার, চায়ের সামগ্রী, বাদাম, খেজুর, চকলেট সহ আরও টুকিটাকি অনেক কিছু। সব ক্যাম্পিং গিয়ার, রোপ, অন্যান্য সব জিনিস ঠিকমতো করে গোছানো হোল।
এবার ঘুমের পালা…অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে…এত বড় দল নিয়ে ইয়ালা সামিট সফর কেমন হবে? সাইফ যদি আবার অসুস্থ হয়ে যায়…?
Leave A Comment