ইয়ালা ডায়েরী - পর্ব ৩ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ৩ 

৭ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ৫

ঘুম থেকে উঠলাম, মোবাইলে সংকেত দেবার আগেই। প্রথমে বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পরার চেষ্টা করলাম পায়ের অবস্থা বোঝার জন্য, বুঝলাম অলৌকিক ঘটনা হয়ে গেছে! পায়ে কোনো ব্যথা নেই! এটা কীভাবে সম্ভব? আমি একদম বোকা হয়ে গেলাম! মাহিকে বললাম, ও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিল, মনে হল যেন রাতে ব্যথা হবে সকালে থাকবে না, এটাই বুঝি খুব স্বাভাবিক। মনে মনে লাফাচ্ছি, কারণ আমাকে এখানে থাকতে হবে না, আমি দলের সাথে ল্যাংটাং পর্যন্ত যেতে পারবো। শুরু হয়ে গেল সকালের প্রস্তুতি…প্রথমে পানি খাওয়া, এরপর জানালার পর্দা সরিয়ে আরেকবার বোকা হলাম, চোখ বরাবর যে জায়গা দেখতে পাচ্ছি, তাতে কিছু ধাতব তার আর সামনে বাঁধাকপি…অর্থাৎ, আমাদের এই রুমটা কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলেও বেসমেন্টের মত অপেক্ষাকৃত নীচু জায়গা থেকে শুরু হয়েছে। লামা হোটেলের অবস্থান চ্যাংডাম গ্রামে, এর উচ্চতা ২৪১০ মিটার। একটি মনোরম গোছানো গ্রাম, যেখানে উচ্চ পর্বতের সাথে তৃণভূমিও আছে। এখানকার স্থানীয় মানুষ একটি খাঁটি পাহাড়ি জীবনযাপন করে। অল্প সময়েই আমার মনে হয়েছে এরা নিজের কাজকে ধর্মের মত পালন করে, এদের আন্তরিকতা দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এখনো আমরা রাসুওয়া জেলাতেই আছি। 

নামাস্তে সিম লামা হোটেলে কাজ করছে না। মনটা খারাপ হল! মোটামুটি ভাবে ঠিকঠাক হয়ে ডাইনিং এ গেলাম সকালে নাস্তার জন্য। কি মনে করে যেন আমি এই ল্যাংটাং এরিয়া এবং উপত্যকা সম্পর্কে আগে থেকেই ইন্টারনেট থেকে স্ক্রিন শট নিয়ে রেখেছিলাম। এখন বসে বসে নাস্তা আসার আগের সময়টা কাজে লাগাচ্ছি।

ল্যাংটাং উপত্যকা, নেপালের বাগমতি প্রদেশের রাসুওয়া জেলায় অবস্থিত। কাঠমান্ডু থেকে উত্তরে উপত্যকাটি, ল্যাংটাং জাতীয় উদ্যানের মধ্যে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের, তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সীমান্তবর্তী। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের আগে, উপত্যকায় ৬৬৮ জন মানুষ বসবাস করত বলে অনুমান করা হয়েছিল। এখানে ঐতিহ্যগত জীবিকা কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে, ল্যাংটাং উপত্যকায় জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছিল পনির। ১৯৫০ এর দশকে ভার্নার শুলথেস ল্যাংটাং-এ সুইস পনির তৈরির প্রচলন করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে, সুইস পনির ল্যাংটাং-এর একটি জনপ্রিয় পণ্য হয়ে ওঠে এবং এর উৎপাদন আজও অব্যাহত রয়েছে। ল্যাংটাং হিমাল পর্বতশ্রেণির মধ্যে অনেকগুলো ৬ হাজার মিটারের পর্বত, ৭ হাজার মিটারের ল্যাংটাং লুরিং আর ল্যাংটাং রি আছে, ৫ হাজার মিটারের ২ টা পর্বত আছে, এর মধ্যে ইয়ালা পিক অন্যতম। ৭২৩৪ মিটারের ল্যাংটাং লুরিং এ প্রথম সামিট করেন সেইশি ওয়াদা এবং পেম্বা সেরিং শেরপা, ১৯৭৮ সালের অক্টোবর ২৪ তারিখে। নাম দেখে সেইশি ওয়াদাকে জাপানি মনে হচ্ছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক, ওনার সম্পর্কে ইন্টারনেটে কোনো তথ্যই পেলাম না, একজন সেইশি ওয়াদাকে পেলাম, যার ওয়াটজ নামে একটা কোম্পানি আছে, কিন্তু পর্বতারোহণের সাথে কোন সম্পর্কই নাই! 

আমি গত দিনের মতো প্যানকেক নিলাম সাথে ডিম সিদ্ধ। আজকেও কেউ নুডলস্, কেউ রুটি ডিম ভাজা, কেউ শুধু ডিম সিদ্ধ এভাবে করে নাস্তা করলাম। এখন পর্যন্ত সবার শরীর সম্পূর্ণ ঠিক আছে, সবাই ফুরফুরে মেজাজে আছে এবং সঠিকভাবে পেট ভরে প্রতিবেলায় খেতে পারছে। বরাবরের মতো খাবার নিয়ে হৈ হুল্লোর কাড়াকাড়ি হচ্ছে। ডাইনিং এর সময়গুলো সবচেয়ে মজার হয়। কারণ বিকালের পর থেকে বেশিরভাগ সময়ই এখানে থাকা হয়, এর একটা বড় কারণ হচ্ছে ডাইনিং গুলোর ঠিক মাঝে একটা চিমনির মতো থাকে, হিটারের মতো কাজ করে, এটা দিয়ে রুমটা গরম থাকে। গল্প হয়, কার্ড/উনো খেলা হয়, আড্ডাবাজি হয় আর প্রাণ খুলে হাসাহাসি হয়। লামা হোটেলের ডাইনিং রুম টা অপেক্ষাকৃত ছোট। আমাদের সম্পূর্ণ দল দিয়ে ডাইনিংটা একদম ভরে যায়।

৭ টা ৩০ এর দিকে আমরা প্রস্তুত আজকের যাত্রার জন্য। আজ সকালে ট্রেক শুরু করার আগে আমাদের পোর্টার মিংমা জানতে চাইলেন আমার কোনো সমস্যা আছে কিনা, আমি বললাম সমস্যা একটা আছে, সেটা হল আমার বয়স, তুমি কি এক্ষেত্রে কোন সহযোগিতা করতে পারবা? ও একটু হেসে চলে গেল…এই এক জায়গায় কেউ কাউকে সহযোগিতা করতে পারে না, নিজের বয়সটা সবার নিজেরই বহন করতে হয়। ট্রেক শুরুর প্রথম ২/১ মিনিট সবার সাথেই ছিলাম, তারপর সবসময়কার মত আমি আর মাহি পেছনে। মাহি বেচারা আমার জন্য অনেক ধীরে ট্রেক করতে হয়েছে, এটা নিশ্চয়ই ওর জন্য কষ্টকর। আজকে থেকে আমি আর কোন ব্যাগ নিলাম না, মাহি একটা বড় ব্যাগ বহন করছে যাতে আমার সব জিনিস ছিল। আমার পকেটে হলস আর সানবব্লক ছিল, জান চলে যাক কিন্তু রঙ পুড়তে দেওয়া যাবে না ????। মাহি আমাকে বার বার বলছে, একটা পেস ধরে রাখতে, তাহলে আমি কম ক্লান্ত হব। রাতে ভাল ঘুম হওয়াতে যেমন পায়ের ব্যাথাটা নেই, তেমনি শরীরও হালকা লাগছে। আমি সবসময় নিজের ক্ষমতা থেকে অনেক কম খাই এক বসায়, যার জন্য কোন অস্থিরতা লাগছে না, এতে করে একটা সমস্যা হয়, তা হল বার বার খুদা লাগা! সামান্য সমতল আর নিচু ছাড়া আজকের ট্রেক সম্পূর্ণই উঁচু আর সিঁড়ি পথ। কিছুক্ষণ আমি দ্রুত হাঁটছি আবার ক্লান্ত হয়ে গেলে ধীরে হাঁটছি, এই পেস ব্যাপারটা ধরতে পারছি না। প্রথম দিন থেকেই মাহি ‘ম্যাপস মি’ নামে একটা অ্যাপ ব্যাবহার করছিল যাতে ব্যবহারকারীর হাঁটার গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে গন্তব্য অনুযায়ী সময় বলে দেয়। মাহি প্রতিবারই সময় বলছে আর আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে যে বাড়িয়ে/কমিয়ে বলছে নাতো? দেখলাম, ঠিকই বলছে। মাহি সাধারণত জিনিসের দামের ক্ষেত্রে প্রথমে একটু বাড়িয়ে বলে চমকে দেবার জন্য। ওর এই অভ্যাসটার জন্য আমি এখানেও ওকে সন্দেহ করছি বলে আমি ওর উপর বিরক্ত হলাম আর এই বাড়িয়ে কমিয়ে বলে চমক দেবার অভ্যাসটা বাদ দিতে বললাম।

আজকের পথে প্রথম দিকেই কয়েকটা ছোট ছোট ঝর্ণা দেখতে পেলাম, দেখতে ছোট হলেও এর পানির প্রবাহ নদীর মত গতিশীল। কিছু সমতলের মত জায়গাতেও ঝর্ণার পানি দিয়ে ভেজা ছিল। ট্রেকে পাশ দিয়ে বিভিন্ন দলের পোর্টারদের অনেক ওজন নিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য যেমন একদম নিয়মিত, তেমনই ভিন্ন ভিন্ন দেশী ট্রেকাদের সাথে দেখা হওয়া। কম বেশী সবার সাথেই কুশল বিনিময় হয়। মোটামুটি সবাই আমাদের স্থানীয় মনে করে নামাস্তে বলে, আমরাও একই ভাবে উত্তর দেই। এমনকি কিছু কিছু স্থানীয়রাও আমাদের দেখে নেপালী ভাষায় কথা বলা শুরু করে, তখন আমাদের বলতে হয় আমরা বাংলাদেশী! দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষের চেহারা কিছুটা একই ধরনের হওয়াতে নেপালে আমাদের অনেকেই ভারতীয় মনে করে। যেহেতু নেপালীরা বিভিন্ন কারণে ভারতীয়দের পছন্দ করে না, প্রথমেই হিন্দি বললে কেমন যেন গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় বলে মনে হয়। তাই আমরা চেষ্টা করি সবার সাথে প্রথমে ইংরেজিতেই কথা বলতে।

আমি আর মাহি বাদে দলের বাকি সদস্য রিভার সাইড হোটেলে 

বেলা ১১ টার দিকে আমরা রিভার সাইড হোটেল, ২৭৬৯ মিটার এ বিরতি নিলাম, প্রতিটা বিরতিতেই এমন হয় যে আমাদের দলের সবাই বিরতি নিয়ে চলে যাবার ঘন্টাখানেক অথবা কিছু বেশী সময় পর আমরা পৌঁছাই আমার গতির কারণে! মাহি আমাকে রসুনের স্যুপ খাওয়ার পরামর্শ দিল। আমরা একটা স্যুপ আর চা নিলাম। প্রকৃতির বিশালতায় আমরা ক্ষুদ্র কয়েকজন মানুষ…কেমন যেন স্বপ্নের মত একটা জায়গা মনে হল! আশপাশটা এতই বেশী সুন্দর, মনে হচ্ছে যেন বড় কোন টিভি পর্দার ভেতরে আমরা পাহাড় আর ঝিরির পানির ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছি! প্রতিটা বিরতিতেই আমার হাঁটুর সাপোর্ট টা খুলে বসতাম, একটু নাড়াচাড়া করে বসতাম আর যাবার সময় আবার পরে নিতাম, মাঝে মাঝে একটু করে বায়োফ্রিজ লাগতাম। আমার প্রয়োজনীয় এই ছোট ছোট জিনিসগুলো আম্মু মনে করে নিয়ে আসে। আমার বহিরঙ্গন কাজের সাথে সম্পৃক্ততা আম্মুর পছন্দ, এজন্য সবসময় আসার সময় ক্যাম্পিং এ সহায়ক এরকম অনেক জিনিস নিয়ে আসে, এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, মলম আর স্প্রেও থাকে।

আবার যাত্রা শুরু করলাম। এখান থেকে ল্যাংটাং গ্রাম পর্যন্ত ট্রেকিং এর পরিবেশটা অনেক সুন্দর, ট্রি লাইন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু তার পরেও এখনও সবুজ পাতা হলুদ পাতা দেখা যাচ্ছে এবং সূর্যের আলো আশপাশ দিয়ে আসা যাওয়া করার কারণে খুব সুন্দর আলোর ছটা তৈরি হচ্ছে। মাহি সিদ্ধান্ত নিল, আজকে আমরা ল্যাংটাং গ্রাম, যেখানে আমাদের দলের সবাই থাকবে, সে পর্যন্ত যাব না। আমরা তার কিছু আগেই থাংসাপের কোন হোটেলে থাকবো। এতে করে আমি বিকাল আর সন্ধ্যাটা একটু বিশ্রাম পাবো এবং সকালে একটু ভালোমতো ট্রেক করে কেঞ্জিং গোম্ফা চলে যেতে পারবো। অর্ণবের সাথে ফোনে কথা বলে ওখানে কোন হোটেল বুক করতে বলল, অর্ণব জানালো এখানে সব হোটেলই খালি, বুক করতে হবে না, এমনিতেই রুম পাওয়া যাবে। আজকে ট্রেক করতে আমার অপেক্ষাকৃত অনেক কম কষ্ট হল। দুপুরের সময় থেকে ট্রেকটা একদম সমতল ছিল। একটা জায়গা এমন ছিল যেখানে ক্যাম্পিং করার মত পরিবেশ। অনেক বড় একটা গ্রুপ বসে ছিল, দুইজন ফ্রিসবি খেলছিল। মাহি ওদের সাথে কিছুক্ষণ ফ্রিসবি খেলায় যোগ দিল। রাস্তাটা এত বেশী সুন্দর ছিল যে মাহি গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ট্রেক করছিল। পাশ দিয়ে এক বিদেশিনী “although I don’t understand the words, but he has a good voice” বলে পাশ দিয়ে চলে গেল। মাহিকে ইশারা দিয়ে জানতে চাইলাম, এই মুহূর্তে অনুভূতি কি?

মনে হচ্ছিল যদি বাকি পথটুকু এমনই হতো! এত স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটছি, মনেই হচ্ছে না যে ৩০০০ মিটারের কাছাকাছি আছি। বার বার মনে হচ্ছে, আমিতো এই ট্রেকে এসেছিলাম অর্ণবের ইচ্ছায়, নিশ্চয়ই ওর মার সাথে সাথে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার পায়ের অবস্থার জন্য হল না। এমনিতেই মাহি আমার সাথে আটকে আছে, আমার ভাল লাগছে না, এর সাথে যোগ হল অর্ণবের সাথেও ট্রেক করতে পারছি না, এই খাপার লাগা। মাহি অ্যাপ দেখে বলে দিল আমাদের খুব বেশী সময় লাগবে না আজকের দুপুরের খাবারের বিরতি নিতে। বিরতি হল ঘোড়া তাবেলা, ২৯০০ মিটার। ট্রেকারদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিরতির জায়গা, ঘোড়া তাবেলা, যেখানে বিশ্রাম নেওয়া যায়, খাবার পাওয়া যায় এবং ক্রমবর্ধমান উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়। উচ্চতা জনিত অসুস্থতা এড়াতে ও নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য অনেকেই অভিযোজনের জন্য এখানে রাতে থাকে। “ঘোড়া তবেলা” নামটি সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে অতীতে ঘোড়ার আস্তাবল থাকার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে, যেখানে ভ্রমণকারীরা তাদের ঘোড়াগুলিকে বিশ্রাম দিতেন। 

এসেই শুনলাম, আমাদের দল কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে, যেহেতু ওরাই প্রথম দিকের গেস্ট ছিল, খাবার প্রস্তুত করতে প্রায় ২ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। হোটেলের জানালায় মিশন হিমালয়া ২০১৯ এর স্টিকার দেখতে পেলাম। এই যাত্রায় আফসোস রয়ে গেল, কোনো স্টিকার আনা হয় নাই। মাহি আগেই নেপাল চলে যাওয়াতে অনেক কিছুই পরিকল্পনা মতো করতে পারি নাই। রেস্টুরেন্টের মালিক মাহিকে চিনতে পারলেন, ২০১৮ সালে ইয়ালা যাবার জন্য পোর্টার ছেম্বেলের সাথে মাহিকে এই হোটেলের মালিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ওনার স্মৃতিশক্তি দেখে অবাক হলাম, ২০১৮ তে দেখার পর কীভাবে উনি এই ২০২৪ সালে এসে মাহির চেহারা মনে রেখেছেন। এই প্রথম কোন নেপালী একজনকে মনে হল একটু শক্ত ধরনের চেহারা আর অপেক্ষাকৃত চতুর ধরনের, ওনার চেহারায় অন্যান্য নেপালিদের মতো আন্তরিকতা একটু কম। আমি ওনার কাছে থেকে ২০০ রুপির মোবাইলের ব্যালেন্স নিলাম। খাওয়া শেষ করেই আমরা বাইরে গেলাম একটা ভিডিও করার জন্য। তৌকির কে পত্রিকা থেকে ভিডিও পাঠাতে বলেছে, সাথে যেন মাহির কথাও থাকে। আমাদের ভিডিও প্রথম বারেই ঠিক হল, পাঠিয়ে দিলাম তৌকিরকে। এই ভিডিওতে বলা হয়েছিল, একই অভিযানে এই তিনটা (মেরা, লবুচে আর আইল্যান্ড) পিক প্রথম কেউ সামিট করেছে, যা দুঃখজনকভাবে পত্রিকায় এসেছে বাংলাদেশের কেউ প্রথম তিনটা ৬০০০ মিটারের পিক সামিট করেছে, যা তাদের বোঝার ভুল ছিল।

মাহিকে এভাবে মারতে মারতে অভিযোজন করেছি, সামিট হোটেল থেকে একশ মিটার উপরে।

খাওয়া শেষ করে আমরা রওনা হলাম, আজকে আর বেশিক্ষণ আমরা হাঁটবো না। আমরা থাংসাপ এর কাছাকাছি, এমন সময় একজন ট্রেকার কান্না অবস্থায় চোখ মুছে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? মেয়েটা বলল, ফোনে নিশ্চিত করার পরও ওর হোটেল বুকিং রাখে নাই, এই বলেই বেচারি হন হন করে হেঁটে চলে গেল, আমাদের আর কিছু বলারও সুযোগ দিল না। আমরা ভেবেছিলাম ওকে বলবো যে, আমরা তিনজন একসাথে হলে রুম পেতে ওর জন্য সহজ হবে। আমরা সামিট গেস্ট হাউজের সামনে থামলাম, এখানেই আমাদের মিশন হিমালয়ে ২০১৮, ২০১৯ এর দল বিরতি নিয়েছিল, মাহি কথা বলল মালিকের সাথে, ওনার নাম ছিড়িং, আমরা দুইজন শুনে রুম দিতে রাজি হল। ২০২২ এ এসে মাহি ছিড়িং এর বাবার ছবি প্রিন্ট করে দিয়েছিল, যা মাহি ২০১৯ এ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা ব্যাগ রেখে বের হলাম। একবার রুমে যেয়ে আবার হেঁটে আসাটা আমার অনেক বিরক্ত লাগে, কিন্তু অভিযোজনের জন্য এটা করাই লাগবে। পাশের পাহাড়েই গেলাম হেঁটে আসতে। পাহাড়ের উপরের দিকে একজন বৃদ্ধ মানুষ দেখলাম, উনি আপনমনে কাজ করে যাচ্ছেন, মাহি আমাকে বলে, তুমি হাঁটতেই চাও না, আর ওনাকে দেখ, হেঁটে হেঁটে উপরে এসে কাজও করছেন! কিছুক্ষণ ওপর থেকে আমরা নিচে নেমে আসলাম। নেমে আসবার সময় আমি পায়ে একটু ব্যথা পাচ্ছিলাম, এজন্য ধীরে ধীরে নেমে আসলাম। নেমে আসার পরে আমাদের সেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হল যে রুম পায়নি বলে কান্না করছিল। মেয়েটা অবাক আর কিছুটা বিরক্ত হল যখন জানল, আমরা সামিট হোটেলে রুম পেয়েছি, কিন্তু ওকে হোটেলের মালিক বলেছে যে রুম নাই। এখন সে হাসিমুখে, হাতে ক্যামেরা নিয়ে। সে একজনের সাথে শেয়ারে রুম পেয়েছে, এই বলেই সেই আগের মতোই হুট করে চলে গেল, এবারও আমাদের কিছু বলার সুযোগ দিল না। এখন ওর হাসি মুখের কথা শুনে এবং দেখে মনে হল ও মানসিক ভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন৷। আমাদের হাসির সাথে চেহারার বিভিন্ন পেশিতে যে পরিবর্তন আসে সেটা দিয়ে আমাদের মানসিক অবস্থা কিছুটা আঁচ করা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, আমি কাউকে নিয়ে এমন মন্তব্য করলে, কেউ কেউ (যারা এসব বিষয়ে মোটেও ধারণা রাখে না) আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কারণ, আমরা স্বভাবগতভাবে ধরেই নেই, আমি জানি না, মানে পৃথিবীতে এই ব্যাপারটার অস্তিত্বই নেই, এটাও কিন্তু একটা মানসিক ব্যাধি, এতে যে কোন কিছুই বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়, যা সে আগে থেকে জানে না। 

একটু ঠিকঠাক হয়ে আমরা ডাইনিং এ চলে গেলাম, বাকি সন্ধ্যাটা সেখানেই থাকলাম। প্রায় ৭-৮ জন আছে আমরা ছাড়াও। আমরা প্রথমে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস খাবো বলে ঠিক করলাম। মাহি সাথে করে চাপাতা, পাউডার মিল্ক আর চিনি নিয়ে এসেছিল, শুধু রান্নাঘর থেকে গরম পানি নিয়ে চা বানালো মাহি, অনেক মজা। এখানের লোকেরা চা কিছুটা হালকা খায়, আমরা তো অনেক ফুটিয়ে কালো করে বানানো চা খেয়ে অভ্যস্ত। ফ্রাইস চলে আসলো, পরিমাণে অনেক বেশি। আমরা নিজেদের মত কথা বলছিলাম, এমন সময় দূরে বসা একজন নেপালী ভদ্রলোক বাংলায় আমাদের সাথে কথা বললেন, আমরা খুবই অবাক হলাম! উনি অনেক বছর বাংলাদেশে ছিলেন, চাকরি করতেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম উনি হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ কান্ট্রি হেড ছিলেন, আমি আরও বেশী অবাক হলাম, কারণ ওনার বেশভূষা দেখে বোঝার উপায় নেই যে উনি এত বড় অবস্থানে কাজ করেছেন! আমি সাধারণত সাথে বিজনেস কার্ড রাখি না, কিন্তু মোবাইলের কাভারের পিছনে একটা কার্ড রাখি, সময়-অসময়ে কাজে লাগে তাই। আমি ওনাকে আমার কার্ডটা দিলাম এবং বাংলাদেশে আসলে আমার সাথে যোগাযোগ করাতে বললাম। একই সেক্টরের মানুষ পেয়ে আমার অনেক বেশী ভাল লাগল। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস এর চা খেয়ে এতই পেট ভরে গেল যে আমরা শুধু একটা ডাল-ভাত নিলাম আর আলাদা করে ডিম ওমলেট নিলাম। নেপালে ডিম ওমলেট মানেই দুইটা ডিম পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভাজা করে দিবে যা নিজেই একটা ভারী খাবার। আমি ভাত কিছুটা খেয়েই আর পারলাম না, কারণ ওমলেটেও আমি ভাগ নিয়েছিলাম! আর একটু ভাত, তরকারি রিফিল নিয়ে মাহিকে দিয়ে দিলাম। এখানে মজার একটা টমেটোর চাটনি ছিল। আমরা খাওয়া শেষ করে বাহিরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। আজ সব মিলে মাত্র ৭ ঘণ্টা হেঁটেছি, তাই শরীর ফুরফুরা আছে। কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম মাহির সাথে। অর্ণবরা আছে ল্যাংটাং এর তিব্বতিয়ান গেস্ট হাউসে, নিশ্চয়ই ওরা অনেক মজা করছে… 

মোটামুটি জরুরি জিনিসগুলি রেখে বাকি সব ডাফেল ব্যাগে দিয়ে দিয়েছিলাম, যা আমাদের থেকে কিছু দূরে ল্যাংটাং গ্রামে আছে। তাই রাতে আর সকালে গোছানোর জন্য তেমন ঝামেলা হবে না। ঘুমাতে চলে গেলাম, হাঁটুতে হালকা ব্যথা আছে, মাহি আজকেও পায়ে তেল মালিশ করে দিল। 

৮ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ৬

আজ আমরা একটু বেলা করে ৭ টায় ঘুম থেকে উঠলাম। গুছিয়ে ঠিকঠাক করে নাস্তার পালা। আজও আমি আর মাহি যথারীতি প্যানকেক আর ২ টা সেদ্ধ ডিম নিলাম। আমার প্যানকেকের সাথে মধু ভালো লাগে। এই অভিযানের জন্য আমি নিজেই মধু নিয়ে আসছি, যেটা আমি থাইল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছিলাম। নাস্তা শেষ করে মাহি বিল পরিশোধ করল। যেহেতু এর আগের বার মাহি মালিকের ছবি নিয়ে প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছিল, এবার আমি ভাবলাম, ওনার মেয়ের ছবি তুলি, আর পরের বছর Rope4 থেকে যারা আসবে, নিয়ে আসবে। ছিড়িং তখন রান্নাঘরে ছিলেন, আমি ছবির কথা বলাতে, উনি জামায় লেগে থাকা আটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, no good dress”, আমি বললাম, but you look very good, তখন উনি বাইরে এসে আমার সাথে ছবি তুললেন। আমরা খুব শান্তশিষ্ট ভাবেই রওনা করলাম। আজ গন্তব্য কেঞ্জিং গোম্ফা, ৩৮৮০ মিটার। অর্ণবরাও ৮:২০ এর দিকে যাত্রা শুরু করেছে কেঞ্জিং গোম্ফার উদ্দেশ্যে।

এই ছবিটা আজ যাত্রা শুরুর সময়, ৮ টা বেজে ৭ মিনিট ৩০ সেকেন্ড এর সময় তোলা

সমগ্র ল্যাংটাং অঞ্চল জুড়েই তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য, পাশাপাশি তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের সাথে জড়িত, জটিল খোদাই করা পাথর দেখতে পাওয়া যায়, কারণ তিব্বতের সীমান্ত, বিশাল ল্যাংটাং হিমালের অপর পাশে অবস্থিত। সংস্কৃতি এবং পাহাড়ের পাশাপাশি সবুজ বন ও সুন্দর রডোডেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া, পাইনস, ওকস এবং বাঁশ সহ ফার গাছের দেখা মেলে। কখনও কখনও বিরল এবং অধরা রেড পান্ডাও এই মনোমুগ্ধকর বনভূমিতে পাওয়া যায়। আমি সরাসরি রেড পান্ডা দেখেছিলাম দার্জিলিং এ HMI এর পাশেই যে চিড়িয়াখানা আছে, যা ‘পাদ্মাজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক’ নামে পরিচিত। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরেই, আমি আর অর্ণব মুগ্ধ হয়ে রেড পান্ডা দেখেছি। 

ইতোমধ্যেই আমরা অনেক ঠান্ডার উচ্চতায় চলে আসছি, সকালে শুরুই করছি একদম ডাউন জ্যাকেট পরে। চলার পথের স্মৃতিস্তম্ভগুলো আমাকে অনেক আহত করে, এখন দাঁড়িয়ে আছি একটি স্মারকের সামনে, যা ১০ জন নেপালী সৈন্য যারা এপ্রিল ২০১৫ তে নেপালের ভূমিকম্পে (যা গোর্খা ভূমিকম্প নামেও পরিচিত) মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের সম্মানে। নেপাল, ভারত, চীন এবং বাংলাদেশ মিলে মোট ৮,৯৬২ জন নিহত হয়েছিলেন, আর ২১,৯৫২ জন আহত হয়েছিলেন এই ভুমিকম্পে, যা ২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে হয়েছিল, এবং এর তীব্রতার মাত্রা ছিল ৭.৮।

এখন আমরা আছি চামকি, ৩২৪০ মিটার, এখানে বোল্ডারিং এর জন্য প্যাড ভাড়া পাওয়া যায়। এই রাস্তায় এত বড় বড় বোল্ডার আছে যে আমি নিশ্চিত, আমাদের দল এখানে অবশ্যই বিরতি নিবে এবং অর্ণব এই বোল্ডার গুলো দেখে না আরোহণ করে থাকতে পারবে না। যারা আগ্রহী হবে নিশ্চয়ই সবাই আরোহণ করবে। একটা ছোট্টো দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় আপেল দেখে  দাড়ালাম, দোকানের লোকটা একটা আপেল নামিয়ে দিল উপরের তাক থেকে, আমি দেখলাম একটু দাগ আছে, উনি আবার বাছাই করে ভাল একটা নামিয়ে দিলেন। মাহি একটু পেছেনে ছিল, বলল, সামনে যেখানে বিরতি নিব সেখানেও আপেল আছে। আমার মনে হোল ওনার কাছ থেকেই নেই কারণ, উনি একটা আশা করে আমাকে আপেল দেখিয়েছেন, উনি যা দাম বললেন সেটাই দিলাম, ২৫০ রুপি। আজ ট্রেকিং এর রাস্তাটা টা বড়, ছোট প্রার্থনা চক্র বা ফরচুন হুইল দিয়ে বেষ্টিত। অনেক জায়গায় উইলগুলো অনবরত ঘুরছে, যা ঝর্ণা থেকে নেমে আসা পানিকে পাইপে করে চক্রের নিচের পাখাতে ধাক্কা দিচ্ছে আর চক্রও অনবরত ঘুরছে। এখন আর কোন বড় গাছ দেখা যাচ্ছে না, ভ্যালিকে তাই অনেক বেশী বিস্তৃত মনে হচ্ছে। ঝর্ণার সমারোহ এখনও চলছে। আমরা ১০ টার দিকে একটা ছোট্ট বিরতি নিলাম। সেই লজের মালিক খুব প্রশংসা করলেন ওনাদের ইয়াকের দুধের টক দই খেতে, নিলাম, খেতে ভাল তবে একটু বেশি টক। সাথে যে আদা চা নিয়েছিলাম, সেটার সাথে আলাদা করে চিনি দিয়েছিল, সেই চিনি দইয়ের সাথে মিশিয়ে খেলাম, অনেক মজা লাগল। সেই আপেলটাও খেলাম। কিছু দূর সামনে এগোতেই একটি পর্বত দেখে আমি একদম থমকে দাঁড়ালাম, মুহূর্তেই আমার সব ক্লান্তি চলে গেল। কারণ এই পর্বতটি আমি ইন্টারনেটে অসংখ্য বার দেখেছি, আর এর কোন সঠিক তথ্য পাইনি কারণ আমি এর নামই জানতাম না। মাহি বলল এই অসম্ভব সুন্দর বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের নাম গাঞ্ছেনপো অথবা গাঞ্ছাম্পো। আমি বললাম, আমি কিছুক্ষণ এখানেই থাকি আর এই পাহাড়কে মন ভরে দেখি! মাহি জানালো এটা বাকি পথ কেঞ্জিং গোম্ফা পর্যন্ত আমাদের পাশেই থাকবে। আমি সাধারণত কিছুতেই তেমন একটা বিমোহিত হই না, কিন্তু এই গাঞ্ছাম্পো আমাকে বিমোহিত করে ফেলল! এই চূড়াটিও রাসুওয়া জেলায়ই পরেছে, যার উচ্চতা ৬৩৭৮ মিটার। এটা কাঠমান্ডুর দিক থেকে উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থিত। প্রধানত, এই পর্বতের চূড়া হল উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে তিনটি পর্বতশৃঙ্গের মিলনস্থল। নেপালের হিমাল পিক প্রোফাইল অনুসারে, ল্যাংটাং দিক থেকে টেরি বেক ও চেরি বেক দম্পতি পর্বতটি প্রথম সামিট করেন ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে।

আমি আর গাঞ্ছাম্পো

পাহাড়ে হাঁটার সময় কিছুদূর পরপরই শিলাস্তূপ দেখতে পাওয়া যায়। কোনও কোনও শিলাস্তূপ অনেক বড়, আবার কিছু কিছু আকারে ছোট। হাঁটার সময় শিলাস্তূপ হাতের ডানদিকে রাখাটা একটা শিষ্টাচার এবং শ্রদ্ধা। শুধু শিলাস্তূপই নয়, প্রার্থনা চক্র, মন্দির, এগুলোও হাতের ডানদিকে রেখে হাঁটা উচিত, যদি একদমই রাস্তা না থাকে সেক্ষেত্রে অন্যথায় হতে পারে। শিলাস্তুপ মূলত ট্রেকিং রুট চিহ্নিত করে (আমাদের কানামো অভিযানে কোন গাইড ছিল না, শিলাস্তুপ দেখেই আমারা ট্রেক করেছিলাম)। 

দুপুরের বিরতি নিলাম নিমা হোটেলে একদম ছোট্ট, কোন গেস্ট ছিল না, খাবার তৈরি করতে একটু সময় নিল। এই হোটেলের পাপড়টা একটু ছোট আর একদম গোল, তবে দুইটা করে দিয়েছে। মালিক খুবই আন্তরিক, হাসিমুখেই সব কিছু এনে দিচ্ছেন। আমার কাঁচা মরিচ খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল, চাইলাম। প্রথমে আসলো লাল মরিচের আচার, তারপর মুলার আচার। আসলে উনি বুঝতেই পারেনি যে আমরা কি চাচ্ছি। উনি একটু ইতস্তত করে চলে গেলেন, কিন্তু ভর্তুকি হিসাবে আরও দুইটা পাপড় নিয়ে আসলেন! আমার কোক খেতে ইচ্ছা হল, ৩০০ রুপি। আমরা একটু অবাক হওয়াতে উনি বললেন, ৩০০ ডলার তো না! উনি আমাদের কথোপকথন খেয়াল করছিলেন, বললেন, ওনাদের ঘোড়া আছে, এমনকি হেলিকপ্টারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। আমাদের কথার মধ্যে আমার দুর্বল লাগার কথাটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন। সারাক্ষণ গাঞ্ছাম্পো আমাদের চোখ বরাবরই ছিল। আবার হাঁটা শুরু হল। নিমা হোটেলের পরের বেশ কিছুটা সমতল ছিল। একটু একটু করে এগুচ্ছি, হাঁটুতে সরাসরি ব্যথা না থাকলেও, একদম সোজা হয়ে হাঁটতেই পারছিলাম না। কিছুটা বৃদ্ধ মানুষের মত করে বেঁকে হাঁটছিলাম। মনে মনে ভাবলাম, আরও যখন অনেক বেশী বয়স হবে, যদি বেঁচে থাকি, কীভাবে চলাফেরা করবো? জানি না তখন কোথায় থাকবো…একটু নিচের দিকে নেমে বেশ অনেকটাই সমতল পাথরের রাস্তা। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার টয়লেট যাবার প্রয়োজন হল, একটা হোটেল খুব সুন্দর করে দেয়ালের মত ঘেরাও করা। আমি হোটেলের ভেতরে গেলাম, কেউ নাই, টয়লেট ব্যবহার করেই বের হয়ে দেখি মাহি দেয়ালের উপর বসে গতকাল রিভার সাইড হোটেল থেকে কেনা সেই গাজরটা কাটছে। ছোট্ট বিরতি হল। আবার পথের শুরু হল। খুব সুন্দর করে লম্বা সারি করে শিলাস্তুপা বানানো। ২০১৮ সালে সাদিয়া এ পর্যন্ত এসেই মাহি আর সুজনকে বিদায় দিয়েছিল। ওরা ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই ছিল, এমনকি যে হোটেলে ছিল তাদের পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানেও গিয়েছিল! 

সুন্দর সমতল রাস্তা, চারটি সাদা ঘোড়া দৌড়ে আসছে, এতই মুগ্ধ হয়ে তাকিতে থাকলাম যে ছবি তুলতেই ভুলে গেলাম। উঁচু রাস্তা শুরু হয়ে গেল, সাথে খচ্চরের পাল গুলোও পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। খুব ভাল লাগে বাচ্চা ইয়াক দেখতে। পৃথিবীর সকল শিশুই অনেক সুন্দর আর আদুরে হয়। 

হঠাৎ, অনেক পাতলা একটা ঠান্ডা বাতাস লাগলো, আমরা আবার একটা ছোট্ট বিরতি নিলাম, এমন একটা জায়গায়, যেখানে আগে দোকান ছিল, এখন বন্ধ। পাথর দিয়েই বেঞ্চ বাঁধানো। বসলাম, মাহি ব্যাগের ভেতর থেকে ডাউন জ্যাকেট বের করে দিল, পরে নিলাম, পানি খেলাম, হাঁটা শুরু করলাম। কিছুটা হোয়াইট আউটের মত, এত কুয়াশা, যে কয়েক ফিট সামনেই ভাল করে দেখা যাচ্ছে না! আসলে এগুলো মেঘ ছিল। এরপরের অনেকদূর রাস্তা একদম পাথুরে। হাঁটা শুরু করেই ২-৩ মিনিটে আমি আবার বসলাম, খুব বিরক্তিকর লাগছে এই ঠান্ডাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মাহি বলল, আমাদের হাতে সময় আছে, তুমি কিছুক্ষণ বসে থাকো, ওই যে মন্দির দেখা যাচ্ছে ওটার পাশ দিয়েই আমাদের রাস্তা, খুব বেশী দেরি নাই আমাদের কেঞ্জিং গোম্ফা পৌঁছাতে। উঠে আবার হাঁটা শুরু করলাম, আশপাশটা এত সুন্দর যে বর্ণনা করার মত না! আমি শুধু বারবার গাঞ্ছাম্পো কে দেখছি, জ্বলজ্বল করছে।

কেঞ্জিং গোম্ফা

হঠাৎ করেই বাতাস কমে গেল, কিছুটা গরম লাগা শুরু হোল। কিছুক্ষণ আগেই জ্যাকেট পরলাম, এখনই আবার খুলতে হবে, পাহাড়ে ধৈর্য থাকাটা খুব বেশী জরুরি! কেঞ্জিং গোম্ফার ঠিক আগের রাস্তাটা অনেক সুন্দর। গন্তব্যের কাছাকাছি আসলে এমনিতেই শক্তি চলে আসে, ঠিক যেমন রিমচে থেকে লামা হোটেল যাবার সময়টাতে শক্তি চলে এসেছিল। আমরা অনেক কাছাকাছি, যেয়েই অর্ণবের সাথে দেখা হবে, এই চিন্তায় আমি অনেক অস্থির হয়ে আছি। আমাদের দলের সবাই আজ সকালে ল্যাংটাং গ্রাম থেকে ট্রেক করে কেঞ্জিং গোম্ফা পৌঁছেছে দুপুর ১ টার দিকে, অভিযোজনের জন্য ওদের কেঞ্জিং রি, ৪৭৭৩ মিটার ট্রেক করার কথা। সব বিরতিসহ আজ আমরা ৮ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ট্র্যাক করে কেঞ্জিং গোম্ফা পৌঁছালাম। ছবিতে চেরাহা দেখে মনেই হয় না যেন কোন ক্লান্তি ছিল, গন্তব্য চলে আসলেই আমরা পেছনের কষ্ট ভুলে যাই। কিন্তু আমাদের এই গন্তব্যে আনার জন্য যে অথবা যাদের অবদান থাকে, আমাদের কখনোই তা ভোলা উচিত না। আমি মাহির কাছে বার বার কৃতজ্ঞ, এত ধৈর্য সহকারে আমাকে এই উচ্চতা পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য। তৌকির কে ফোন করে জেনে নিলাম আমাদের হোটেল কোনটা? গোলাপি রঙের হাইয়ার হোটেল। ওরা সবাই কেঞ্জিং রি এর ট্রেক এ আছে। আমরা হোটেলে গেলাম, পছন্দ হলো না! চার তলা একটা বন্ধ ধরনের দালান, মাহি হোটেল দেখে একদম বেশী বিরক্ত হলো যখন জানলো ডাইনিং চার তলায়! 

আমরা একটু ঠিকঠাক হয়ে বের হলাম,  সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ, অভিযোজনের জন্য। যাবার সময় আমরা একটা ক্যাফেতে বসলাম, ‘দর্জি ক্যাফে‘। ছিমছাম গোছানো একটা দোকান, অনেক ধরনের স্ন্যাক্স আছে, সাথে কফির ভাল জোগাড় আছে। একটা সিনামন বান আর কফি নিলাম, যদিও আমি গরম মশলা পছন্দ করি না, কিন্তু দারুচিনির এই নাস্তাটা আমার ভাল লাগে। মাহি বলল, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আমি কিছু বললাম না, মাহি জানে আমি অভিযোজনের ব্যাপারে অনেক নাখোশ, বলল, আচ্ছা, আমরা এগুলো শেষ করেই যাচ্ছি। মাহি আসলে ভেবেছিল, যদি আমরা একটু আগে ট্রেক শুরু করি, তাহলে অন্য সবার সাথে ফিরতে পারবো। শুরু করলাম হাঁটা, একদম মাটি পথ, ছোট ছোট গাছ আছে। এই গাছগুলোই নিচে বড় ছিল। আমি গতকাল আর আজ একই গাছের পাশে দাঁড়িয়ে, হাত দিয়ে মাপ দিয়ে ৪-৫ টা ছবি তুলেছি। যাতে বোঝা যায় কিভাবে উচ্চতার সাথে গাছের উচ্চতা কমে আসছে। একদম আঁকাবাঁকা করে হাঁটতে হল আরামদায়ক পথের জন্য। একটু হেঁটেই আমি মাহির সাথে চরম বিরক্ত কারণ আমাকে তো আর উপরে যেতে হবে না, কেন আমাকে অভিযোজন করতে হবে? মাহি অনেক ধৈর্য সহকারে বুঝিয়ে বলল, এখানে যেহেতু আমাকে ২/৩ দিন থাকতে হবে, তাই এটা প্রয়োজন। আর একটু, আর একটু করতে করতে মাহি আমাকে ১০০ মিটারের মত উপরে নিয়ে গেল, আশপাশটা অনেক সুন্দর, কিন্তু আমি এতই বিরক্ত, মাথা নিচু করে বসে থাকলাম একটা পাথরে। অনেক দূরে তৌকির আর তাহমিদকে দেখা যাচ্ছে, বেশ অনেকক্ষণ ওদের ছোট্ট ছায়াগুলো এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। এর পর একটু একটু করে নামা শুরু করল। আমি এতক্ষণে একটু ঠান্ডা হয়ে সামনে তাকালাম, সম্পূর্ণ কেঞ্জিং গোম্ফাকে একটা রঙিন পটভূমি মনে হচ্ছে। আমি আর একটু উপরের দিকে যেতে চাচ্ছিলাম, এর মধ্যেই তৌকির আর তাহমিদ চলে আসলো। এসেই তাহমিদ স্বভাবগতভাবে অনেক কথা বলা শুরু করল বিনা থামায়। ও অনেক হাঁপিয়ে যাচ্ছে, মাহি ওকে ইশারা দিয়ে বলল, এগুলো নিচে নেমেও গল্প করা যাবে, এখন সামনে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে নামো। কিছুটা অন্ধকার হয়ে আসছে, হাঁটুর ব্যথাটা নামার সময় বেশি কষ্ট দেয়। চোখ কিছুটা ঘোলা লাগছে, দুর্বল লাগছে, বিরক্ত লাগছে, আর তাহমিদের সফট ভার্শন পাগলামি চেরি অন টপ! যাইহোক, নেমে আসলাম।

আমরা অপেক্ষা করছি, এমন সময়  পাহাড়ের উপরে ক্ষুদ্র আলোর বিন্দু দেখতে পেলাম, ছোট্ট ছোট্ট অনেক গুলো আলো… বুঝে গেলাম, ওরা নামছে, এখনো অনেক উপরে। কিছুক্ষণ ওদের ভিডিও ধারণ করলাম, ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। আমাকে আর তাহমিদ কে হোটেলে যেতে বলে মাহি আর তৌকির গেল অন্য হোটেল দেখতে যেখানে আমি আর তাহমিদ বাকি সময় থাকবো। আমরা হাঁটা ধরলাম, তাহমিদ বলল, আপু, এইতো আমাদের হোটেল, আমি একটু অনিশ্চিত ছিলাম, কারণ আমি একবার গিয়ে মাত্র বের হয়েছি, শুধু মনে আছে গোলাপি রঙ। তাহমিদ খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, আপু দুপুর থেকে আছি, আমি ভাল করে চিনি, এটাই আমাদের হোটেল। এই হোটেলের সিঁড়িগুলো খাঁড়া ধরনের, দোতলায় যাবার পরই একজন জানতে চাইল, আমরা এই হোটেলের গেস্ট কিনা? আমি বললাম, আমি একটু আগেই উঠেছি। গেলাম চার তলায়, ট্রেক করে এসেছি, ক্লান্ত, ডাউন জ্যাকেট খুলে একটু আরাম করে বসলাম, সেই লোক যে দোতলায় জানতে চেয়েছিল, সে খুবই সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আর আবার জানতে চাইল আমরা কোন রুমের গেস্ট? আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম আমরা ১৪ জন এখানে উঠেছি। উনি এবার নিশ্চিত হয়েই বললেন আমরা এই হোটেলের না! দুজনই হোটেলের নাম বলে, ভুল বোঝাবুঝির অবসান হল, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করে বের হয়ে আসলাম, সাথে এও বললাম যে আমাদের হোটেলের একই রঙ হওয়াতে এই ভুল হয়েছে। তাহমিদ আত্মবিশ্বাসের সাথে আমাকে গোলাপি রঙের নামাস্তে হোটেলে নিয়ে গেছে! ঠিক যেমন এয়ারপোর্টে গুবলেট করেছিল! এখন আমার চিন্তা, এই পা নিয়ে আমাকে চারতলা থেকে নেমে আবার চার তলায় উঠতে হবে! বিরক্ত হলাম কিন্তু ও আসলে ইচ্ছা করে এমনটা করে নি। যেহেতু এই মানুষের সাথে আমাকে ২/৩ দিন কেঞ্জিং গোম্ফায় থাকতে হবে…এরপর দুইবার নিশ্চিত হয়ে কিছু করতে হবে।

আমরা ডাইনিং এ বসে আছি, আমাদের পোর্টার মিংমা আর লালের সাথে দেখা হল দুই দিন পর, কুশল বিনিমিয় করলাম, সাথে আমাদের ভুল করে অন্য হোটেল চলে যাবার কথাও বললাম। অপেক্ষা করছি, মাহি আর তৌকির আসল, সাদিক আর নুড়ি সবচেয় আগে নেমে আসলো। ওরা দেরিতে শুরু করার কারণে লোয়ার কেঞ্জিং রি পর্যন্ত যেতে পেরেছিল, যা ৪৪০০ মিটার। এই প্রথম সবার কোন চূড়ায় যাওয়া হল, সবাই অনেক আনন্দিত ছিল। ফারজানা ছিল দ্বিতীয় দলের সাথে যেখানে তৌকির, তাহমিদ আর ফারজানা ছিল, তাহমিদ আর উপরে যাবে না, তাই ফারজানা একাই অনেকটা পথ ট্রেক করে মূল দলের সাথে যোগ দিল শেষ সময়, যখন সবাই ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওরা নেমে আসার সময়, ফারজানার অনেক কষ্ট হচ্ছিল, ও থেকে থেকে কয়েকবার বমি করেছে, ওকে সাথে নিয়েই সবাই একসাথে ফিরেছে ৮ টার দিকে। ফারজানার শরীরটা গতদিন থেকেই ভাল যাচ্ছে না, অনেক ধীরে ট্রেকিং করেছে, ভালমতো খেতেও পারছে না। এসেই বসে বিশ্রাম নেওয়া শুরু করল। 

লোয়ার কেঞ্জিং রি থেকে নামার সময় বিরতি আর দূরে কেঞ্জিং গোম্ফা জ্বলজ্বল করেছে!

মাহি চা বানানোর জন্য ব্যস্ত হল, আমি রান্না ঘর থেকে আলাদা করে গরম পানি আনাতে মাহি রাগ করলো কারণ, ফ্ল্যাক্স ভরে পানি নিলে লাভজনক হয়। সাদিক, আমাদের জনাব নির্ভরযোগ্য,  ছোট্ট একটা কৌটা করে কফি নিয়ে এসেছে। চায়ের সাথে কফিও মিশিয়ে দিলাম, ভালোই লাগল। পাহাড়ে গরম যেকোনো কিছুই খেতে ভাল লাগে। অনেক গল্প হল, খুব সকালে ওঠার চিন্তা নাই। নুড়ি খুব চিন্তিত ভাবে ফোন নিয়ে হাঁটছে। বলল, বাসায় যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে। আমি বললাম, তুমি এত বেশি চিন্তিত কেন? কি হয়েছে? ও কিছু ব্যক্তগত কথা বলল, জমিজমা বিষয়ক ঝামেলা চলছে। অনেক দুশ্চিন্তা নিয়েও ও কত সুন্দর ও নিখুঁত ভাবে ট্রেক করে যাচ্ছে! ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমারও মনে পড়ল, আমার মা খালা গত ২০ বছর ধরে জমিজমা নিয়ে, কোর্ট, উকিল, পুলিশের চক্কর কেটেছে…কিন্তু কোনই লাভ হয়নি!

রাতের খাবারের পর্ব, সবাই যথারীতি যার যার পছন্দ মতো খাবার নিল, খাবার আসলো। যারা ডাল ভাত খাবে, তাদের টা একটু সময় লাগছে। কে জানে কিছুক্ষনের মধ্যে কি সাংঘাতিক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছি… 

চলবে…

ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ১

ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ২

ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ৪