ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ২
৫ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ৩
অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। প্রয়োজনীয় সব কাজ সেরে ব্যাকপ্যাক রেডি, সব রেডি। আমাদের সবাই সাকুরা হোটেলের নীচে জামা হলাম, এক এক করে সবাই বের হল, কেউ ভারী ব্যাগগুলো টানতে হাত দিল, কেউ নিজের মতই হেঁটে বের হয়ে আসলো। একজন ফোনে জানাচ্ছে, “আজকে আমরা রওনা দিচ্ছি”। এই ব্যাপারগুলো যেমন ভালো, মাঝে মধ্যে একটু দম বন্ধ অবস্থা! এখন এই বয়সে এসে মনে হয়, প্রতিনিয়ত খবর নেওয়া দেওয়াটা যে স্বাধীনতা খর্ব হবার মত একটা বিষয়, তা বুঝতে বুঝতে আবেগের কাছে আমরা এমনভাবে নত হয়ে যাই যে নিজেকেই ভুলে যাই! প্রতিটা মানুষ একদম ভিন্ন, পৃথিবীতে সবাই একা আসে, একা চলে যায়, আর মাঝে কতগুলো মানুষকে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে রাখে! সম্পর্কে ছোটখাটো মনোমালিন্য আর ঝগড়া শুরু এই জাতীয় ব্যাপার থেকেই, কেন ফোন দিল না? কেন ফোন বন্ধ ছিল। হাজারটা কেন কেন কেন!
ট্যাক্সি চলে আসলো। আমরা ১২ জন তিনটা ট্যাক্সি করে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম সকাল ৭-৪০ মিনিটে। কাঠমান্ডু শহরের রাস্তা দিয়ে চোখের সামনে বড় পাহাড়কে সামনে রেখে ট্যাক্সি পৌঁছে গেল বাসস্ট্যান্ড, সেখানে আমাদের জিপ অপেক্ষা করছিল, আমাদের দু জন পোর্টার আমাদের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ড থেকে যুক্ত হলেন। সামান্য খানিকটা নিচের দিকে নামার পথ। ডাফেল ব্যাগ ওঠা নামার সময় একজন মানুষ সবসময় এগিয়ে ছিল, সে হল আমাদের সাদিক, এবার যুক্ত হল সুপ্ত। হোটেল থেকে বের হবার সময়, আর বাসস্ট্যান্ডে ব্যাগের রঙ পরিবর্তন করে নিল সাদিক, মনে হয় দুটি ডাফেল ব্যাগ বহনেই ওর আগ্রহ ছিল! ওর মূল আগ্রহ সেচ্ছাসেবীতা, তা একদম স্পষ্ট! খুব সুন্দর করে জীপরে ছাদে বেশীরভাগ ব্যাগ দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল, আমরা যাত্রা শুরু করলাম সাইব্রুবেশির উদ্দেশ্যে। আমি প্রথম সারির সিটে বসলাম আর ভাগ্যক্রমে তাহমিদ ঠিক আমার পেছনে বসল। ফলশ্রুতিতে আমি কোরবানী আর ছাগল বিষয়ক র্যাপ গান শুনতে শুনতে গেলাম বেশ কিছু রাস্তা! যেকোন গাড়িতে আমি সহজেই ঘুমাতে পারি, এখানেও এর বিকল্প হল না। পাশে অর্ণব আর তৌকির, সবাই ঘুম। ওরা দুজন অনেক ক্লান্ত, মেরা অভিযান থেকে ফিরে কোন বিশ্রাম পায়নি। ৯-৩০ মিনিটে নাস্তা খেতে নামলাম। খুব ছিমছাম মোটামুটি ছোট একটা হোটেল, বেশীরভাগ মানুষই স্থানীয়, শুধু আমরাই ভিনদেশী। আমরা নাস্তা সেরে নিলাম। রিং এর মত রুটি আর আলুর দমের মত তরকারি, সাথে ছোলা। সবশেষে চা। এর মাঝে আমাদের পোর্টার লাল এর সাথে কথা হল, ওনার কাছে জানলাম লাল রঙ কে নেপালে ‘রাতো’ বলে। নেপালে লাল শব্দের আলাদা ভাবে কোন অর্থ নেই। পাশেই ছোট ছোট পাথরের একটা স্তুপ ছিল। সেখানে আমরা ছবি তুললাম। ছবিতে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু অনেক কড়া রোদ ছিল।
আবার যাত্রা শুরু হল। কিছু কিছু পথে অনেক ঝাঁকুনি ছিল, জীপের পেছেনের সবার অবস্থা খারাপ হল। মাহি সবাইকে জানিয়ে দিল, আমরা ফেরার পথে অবশ্যই বাসে আসবো। আমি সহ সামনের তিনজন বিভোর ঘুম। আগে আমি যাত্রা পথে অনেক ছবি তুলতাম, এখন মনে হয় শুধু দেখি। একটা চেকপোস্ট পেলাম, আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম, সব ব্যাগ নামানো হল, চেক করা হলো, এই চেকপয়েন্টে মূলত দেখা হয় যে কারো সাথে ড্রোন আছে কিনা, কারণ যদি কেউ ড্রোন নিয়ে যেতে চায় ল্যাংটাং এ, তাহলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। সবার পাসপোর্ট একসাথে করে মাহি গেল কাউন্টারে, সাথে সবার নামের লিস্ট। মাহি আমাকে আগেই বলেছিল যেন সবার নামের একটা লিস্ট তৈরি করে নিয়ে আসি, আমি সবার নাম, পাসপোর্ট নাম্বার, মেয়াদ, জন্ম তারিখ, সাথে যাত্রার তারিখ উল্লেখ করে তিন কপি সাথে রেখেছিলাম। এজন্য ফারজানাকে ধন্যবাদ, ও আমাকে লিস্টটা রেডি করে দিয়েছিল, লিস্টে নারী/পুরুষ উল্লেখ করা থাকলে ভাল হত। চেকিং শেষে কয়েকজন টয়লেট সেরে নিলাম, আবার যাত্রা শুরু।
রাস্তার দুপাশের দৃশ্যগুলো অনেক বেশী সুন্দর, বর্ণনা করা কিছুটা কঠিন। একটা জায়গা আমার অনেক ভাল লাগল, দূর থেকে ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ একটা গ্রামকে এক ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে! ১ টা ৪০ মিনিটের দিকে আমরা দুপুরের খাবারের জন্য একটা রেষ্টুরেন্টে থামলাম, হোটেলটা একপাশে ছোট্ট দোকানের মতো কাউন্টার সেখানে অনেক টুপি মাফলার এগুলো আছে। কাঠের টুকরার মত লম্বাটে মত কি যেন পাঁটের দড়ি দিয়ে বেধে রেখে দিয়েছে, জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওগুলো ইয়াক চিজ। অনেকগুলো কাঁচের বয়ামে খুরসানী আচার আছে। নেপালে মরিচকে খুরসানী বলে। নেপালের সব হোটেলে, মুলার আচারটা সব জায়গায় পেয়েছি। মুলার আচারটা ওদের এখানে অনেক জনপ্রিয় এবং সবাই অনেক পছন্দ করে খায়। এখানের ডালটা অনেক মজা। আমাদের মসুরের ডালের মতই, কিন্তু দেখতে কিছুটা কালো। এখানকার চাল আমার অনেক পছন্দ হয়েছে, একদম চিকন সাদা, কিছুটা আমাদের বাসমতী চালের মতো।
এই হোটেলের সবচেয়ে সুন্দর যায়গা হল, বাহিরের বারন্দাটা, যেখানে ছোট একটা বেঞ্চ আছে, যেখানে তিন জন বসে খেতে পারে এবং সামনে যতদূর চোখ যায়, কিছুটা সবুজ আর পাহাড়। এবেলা আমরা সবাই ডাল ভাত খেলাম। পাহাড়ের ডাল ভাত খাওয়ার আলাদা মজা আছে, সেটা হচ্ছে ভাত ডাল সবজির তরকারি যত ইচ্ছা নেওয়া যায়। অন্য কোন খাবারেই এই সুযোগটা থাকে না। ডাল ভাতের প্যাকেজ টা দেখতে অনেক সুন্দর। এক বাটি ভাত থাকবে উপরে পাঁপড় থাকবে, এক বাটি ডাল থাকবে, একবাটি সবজির তরকারি থাকবে, কিছু শাক থাকবে, কিছু আচার থাকবে। এখানে প্রতিটা হোটেলে কমন খাবার পেয়েছি, সেটা হচ্ছে রাই শাক। এখন থেকে ডাল ভাত প্যাকেজ অনেক দামি। যারা যারা চিকেন পছন্দ করে তারা চিকেন কারিও নিল। তবে শেয়ার করে খেলো। আর আমাদের মধ্যে একজন সেই সুন্দর বেঞ্চে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে শেয়ার করার বদলে তরকারি একাই খেয়ে ফেলল। ওর একা খেয়ে ফেলার জন্য আর একজন তরকারি পেল না। ফারজানা আর সুপ্ত ওদের কাছ থেকে কিছু তরকারি একসাথে করে সেই অভাগা কে দিল।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, আমাদের আশেপাশে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটে, যা নির্মল আনন্দ দেয়ার পাশাপাশি অনেক নিঃশব্দ বার্তা দিয়ে যায়। খাওয়া শেষ করে যখন বেসিনের কলের পানিতে হাত ধরলাম, মনে হল আমি ডিপ ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানিতে হাত দিলাম এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ঢাকা ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর চামচ ছাড়া ভাত খাব না। এই ঠাণ্ডা পানিতে বারবার হাত ধোয়া টা অনেক কষ্টের, আঙ্গুলে কিছুক্ষণ কোন অনুভূতি থাকে না! সুন্দর বারান্দায় বসে ছবি তুলতে মোটামুটি কেউ বাদ দিল না।
আমরা কমবেশি ৮০ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে কাঠমান্ডু থেকে সাইব্রুবেসী তে পৌঁছালাম সারে তিনটার দিকে। রাসুওয়া জেলার গ্রাম সাইব্রুবেসী, এর উচ্চতা ২,৩৮০ মিটার, এটি দুটি পাহাড়ের মধ্যে একটি বিস্তৃস্ত ভূমীর মতো, দূর থেকে কিছুটা সরু দেখা যায়। এই এলাকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ এবং এই গ্রামটি সাদা জলের ভেলা ত্রিশূলী নদীর তীরে অবস্থিত। হোটেল সানরাইজ আমাদের আজকের নিবাস, সব ব্যাগ নামানো হল। হোটেলের জানালার কাঁচে আমরা মিশন হিমালয় ২০১৯ এর স্টিকার দেখতে পেলাম, সেই ১৯ সালেও আমাদের মিশন হিমালয়া দল এই হোটেলেই ছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাস্তা বরাবর হোটেলের চারতলা, কারণ হোটেল টা পাহাড়ের নিচ থেকে শুরু হয়ে, রাস্তা বরাবর চারলতলায় এসে শেষ হয়েছে। আমরা যারা তিনতলায় রুম পেলাম, এক সিঁড়ি নামতে হয়েছে। রুমে ঢুকেই ডাফেল ব্যাগ আর হাতের ব্যগের জিনিসের একটা ব্যবস্থাপনা করে ফেল্লাম। জানালা দিয়ে একটা শব্দ অনেক সময় ধরে মনযোগ পাবার চেষ্টা করছে, পর্দা সরাতেই চোখ আটকে গেল ঝিরিপথের প্রবাহে! ত্রিশূলী নদীর বহমান পানি, ঝিরিপথ দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যেমন সুন্দর তেমন ভয়ংকর, নিজস্বতা নিয়ে এমন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন এর অনেক ব্যাস্ততা, একদন্ড থেমে থাকার উপায় নেই! কোন বড় পাথরই এই গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারছে না। এই মধ্যেই অর্ণব একটু ঘুমিয়ে নিল। হোটেলের কিছু সামনেই একটা মন্দির আছে, সেখান থেকে আমাদের কয়েকজন হেঁটে আসলো। মন্দিরে উঠতে মোট ১১০টা সিঁড়ি, মাঝে অনেকগুলো ফাঁকা সমতল যায়গা। আমি হোটেলেই ছিলাম। হোটেলের সামনেই একটা বেকারি ছিল, আমার মন পরে আছে সেখানে কখন যাব! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো, আমরা সবাই বের হলাম একটু উপর থকে হেঁটে আসার জন্য। সেই বেকারিতে গেলাম, তেমন কিছু ভাল লাগল না, একটা বেণির মত পেঁচানো স্টিকের মত কিছু একটা পছন্দ হল। এক প্যাকেটে চারটা স্টিক, আশি রূপী, নিয়ে নিলাম। মনে হল যেন শেষ করতে পারবো না। এতই স্বাদের কুড়মুড়ে ছিল যে সবাইকে ভাগ করে দিয়ে চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল! আমারা একটা ছোট্ট দোকানে চা খেতে বসলাম, চা একদম মজা ছিল না, কিন্তু ছোট্ট একটা কুকুরছানা আমাদের সকলের আগ্রহের আর আদরের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল, বেচারা এত মানুষের আদরে ভয়ে একদম পালানোর চেষ্টা করছিল। পরে আমরা ওকে ছেড়ে দিলাম।
পাহাড়ে গেলে মনে হয়, অনেক সময়, ঘুম আর খাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন সময় সাপেক্ষ কাজ নেই। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল, এই বেলা কেউ ভাত, কেউ চাওমিন (বেশী পরিমাণে সয়াসসের কারণে কালো ছিল), কেউ রুটি নীল। একজন শুধু মাশরুম কারি নিয়ে ধরা খেল, কারণ এখানে কারি একদম সুপের মত পাতলা ঝোল যা ভাতের সাথে খাওয়ার মত না। কার খাবার কেমন হয়েছে, কে ভাল করে বেশী খেতে পেরেছে, নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন মাহি সবার উদ্দেশ্যে বললো, আমরা কেউ যেন এই বিষয়টা নিয়ে এমন কোন কথা না বলি যাতে অন্য কেউ কষ্ট পায় বা অস্বস্তিতে পরে যায়। সকালের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো কাজ নাই। কিছুক্ষণ গল্প করে সবাই যার যার মত রুমে চলে গেলাম। সকাল ৬:৩০ এ নাস্তার সময় দেওয়া হল।
পাহাড়ি পরিবেশে ভাল লাগার একটা বিষয় হল, রাতে ঘুমাতে আর সকালে উঠতে কোন সমস্যা হয় না। রাতে বেশিক্ষণ মোবাইলে সময় দিতে ইচ্ছা হয় না, ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেওয়াটাই শ্রেয় মনে হয়। মোটামুটি খাওয়া আর ঘুম ঠিকঠাক হলেই, শরীর চাঙ্গা থাকে। পাহাড়ে আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে, রাগ, অভিমান, বিরক্তি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না। মনটা কেমন যেন উদার হয়ে যায় আর সবকিছুই সহজভাবে নিতে ইচ্ছা করে। এর একটা কারণ হতে পারে শারীরিক কষ্ট। পাহাড়ে দৈনন্দিন কাজ আর জীবিকা অনেক কষ্টকর, তাই সবাই অন্যান্য আবেগসাপেক্ষ ব্যাপারগুলোর চাইতে শরীরটা ঠিক রাখাকেই গুরুত্ব দেয়। আমাদের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা এক ভাবেই কাজ করে। আমরা যারা সমতলে থাকি, এত বেশী শারীরিক খাটুনি করি না, যা আমরা পাহাড়ে গেলে করি, তাই আমরাও পাহাড়ে গেলে কিছুটা ভিন্ন মানুষ হয়ে যাই।
ঝিরির পানির বহমান শব্দ আসছ…অনেক ঘুম…
৬ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ৪
সবাই নাস্তার জন্য সাড়ে ছয়টায় ডাইনিং এ একত্রিত হলাম। ডাইনিং হলটা মোটামুটি ছোট, একটা একটু বড় টেবিল যেখানে ছয়জন বসা যায়, আর বাকি দুইটা টেবিল একটু ছোট। আমাদের দলের একজন পাশের একটা টেবিলে বসল, আমার মনে হল রাতে একজন বিদেশি কে দেখেছিলাম, উনি নিশ্চয়ই নাস্তা করতে আসবেন, তাই সেই আমাদের একজন কে বললাম ও যেন আমাদের সাথে চলে আসে। নাস্তা আসতে আসতে প্রায় ৬ টা ৪৫। রুটি ডিম, গরম দুধের সাথে মোজলি, নুডলস, প্যানকেক, বিভিন্ন আইটেম দিয়ে সবার নাস্তা শেষ হল। সব শেষে আদা চা আর বড় ফ্লাক্স ভর্তি গরম পানি, প্রতিবেলায় এই পানি সবার মধ্যে সমান ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন জনের হয়ে থাকে, এ বেলা দায়িত্ব পেল, ইমন, ওকে দেখে মনে হয়, আহ্লাদি, ও ঘরের কোন কাজই পারে না, পরে জানা গেল, ও একমাত্র ছেলে, সব ধরনের ঘরের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। ওর চেহারা ওর সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয়! তবে সবকিছু একটু দেরিতে খেয়াল করে অথবা দেরিতে প্রতিক্রিয়া করে, এই বিষয়ে কোন ভ্রান্তি নেই। পানি ভালোভাবে বণ্টন করল ইমন। এইসব কাজের তদারকি করে কামরুল, আমাদের এই অভিযানের কোয়ার্টার মাস্টার। ওর দায়িত্ব ছিল প্রতি বেলায় ঠিক মতো খাবার আসছে কিনা অথবা খাবার আসতে দেরি হলে সেটা রান্নাঘরে গিয়ে বলে আসা, সবাই পানি পেল কি না, সবাই চা পেল কি না, কেউ কেন দেরি করছে, এসব। আরেকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হল, দলনেতা সাদিক, ঠান্ডা মাথার চুপচাপ ও সংবেদনশীল একজন মানুষ। সাদিক আর কামরুল দুইজন মিলে একটা দায়িত্ব অনেক ভালোভাবে পালন করেছে, কাউকে কোনো খাবার নষ্ট করতে দেয়নি! ব্যাপারটা এমন না যে ওরা জোর করে খাওয়া শেষ করতে বলত, ওরা খাবার শেষ করার দায়িত্ব নিয়ে নিত!
সবাই যার যার রুমে চলে গেলাম। আজকে প্রথম ট্রেকিং সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল। যার যার হাতের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে গেটের কাছে বের হলাম। আজকে আমাদের গন্তব্য সাইব্রুবেসী থেকে লামা হোটেল, কমবেশি ৮/৯ ঘণ্টার ট্রেক আর ১০০০ মিটার হাইট গেইন। সম্পূর্ণ ট্রেকে আমাদের পাশে থাকবে ল্যাংটাং খোলা। নদীর নেপালী শব্দ খোলা। আমরা সবাই প্রস্তুত। শেষ সময়ের ব্রিফিং চলছে। কিছু বিষয় যা ট্রেকে মনে রাখাটা জরুরি, সেগুলো মাহি এক এক করে বলে দিল। যেমন, স্থানীয়রা অপ্রস্তুত হয়, এমন কোন কাজ করা যাবে না, অনুমতি না নিয়ে কারো ছবি তোলা যাবে না, প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না, ট্রেক ময়লা করা যাবে না, আরও ছোটখাটো অনেক কিছু…কারো কারো ব্যাগ ঠিক করে দেওয়া সহ চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ হল। আমরা ট্রেক শুরু করলাম ঠিক ৭ টা বেজে ৪৬ মিনিটে।
একদম প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে আমার কাছে ১৮ লিটারের ব্যাগ ছিল, যাতে আমার ঔষধের আর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হাঁটুর সাপোর্ট ব্যান্ড টা ছিল। যা যেকোনো সময় লাগবে… এছাড়া কিছু ড্রাই ফুড আর হলস ছিল। এই হলসের জন্য আসার আগের দিন আমার যে পরিমাণ ঝামেলা হয়েছে! আমার বাসার এলাকায় হলস পাওয়া যায় না, আমি সবসময় অফিসের সামনে থেকে কিনি। গত বৃহস্পতিবার ভুলে গেছি। হলস ছাড়া আমি কোনোভাবেই নেপাল যাব না। কাঠমান্ডু গিয়ে পাব কিনা এই দ্বন্দ্বে, গুলশান এক ফার্মেসিতে কল দিলাম, ১৫০ করে পাতা চাচ্ছে, অনেক বলে ১২০ এ ফিক্স হল। এবার রাইডারকে কল দিলাম, ৩০ মিনিট ধরে পরপর ৩ জন রাইডার সব কথা বলার পর না করে দিচ্ছে, তৃতীয় জন তো ১৫ মিনিট পর না করেছে, এভাবে রাত ১০ টার দিকে আমার প্রাণপ্রিয় হলস এর ৬ পাতা হাতে পেলাম, শান্তি! চতুর্থ রাইডারের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
এখানে শুরুতে একটা চেক পয়েন্ট আছে যেখানে সবার নামের তথ্য দিতে হয় এবং ফিরে আসার সময় এখানে রিপোর্ট করতে হয়। আমাদের নামের লিস্টটা এখানেও কাজে লাগল, শুধু উল্লেখ করতে হল কতজন নারী আর পুরুষ। হাঁটার শুরুতে আমার পা টা একদম ভেঙে আসছিল। তার কিছু পর স্বাভাবিক হয়ে গেল। পাহাড়ে গেলে এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের তৈরি হয়, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকব, নাকি আশেপাশের সৌন্দর্য দেখব নাকি, নিজের শরীরের অবস্থা বিবেচনা করব। সব মিলে এমন এক অবস্থা যে বোঝা যায় না কী করব? মস্তিষ্ক খুব দ্রুত গতিতে কাজ করতে থাকে৷ আজকের শুরুর দিকের পথটা পাথর, ঝরনা, পানির শব্দ, ঠান্ডা সবমিলিয়ে এক অন্যরকম সমাহার। আমরা এগিয়ে চলছি, অনেকটা পথ আমরা সম্পূর্ণ দল একসাথেই ছিলাম। এর পর গতির বিবেচনায় দল ভাগ হয়ে গেল। আমি যেহেতু অনেক বছর পর পাহাড়ে গেলাম, পাহাড়ি পথে আমাকে অন্যরকম আকর্ষণ করছিল। আমার কাছে সব সময়ই পাহাড়ি পথগুলো শৈল্পিক মনে হয়, কিছুটা মাটির পথ, কিছুটা পানি, কিছু পাথর, কিছু ঘাস, আঁকাবাঁকা, উঁচু নীচু, সিঁড়ি সব মিলিয়ে কেমন যেন, এই পথ যদি না শেষ হয়…গানটা যথার্থ মনে হয়। মনে মনে ভাবছি যেন শরীরটা ঠিক থাকে কারণ আমার একার জন্য হয়ত সম্পূর্ণ দলকেই ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। এমনিতেই মাহি আমার সাথে ছিল, তাই মিশন হিমালয়ের সবাই ওকে ট্রেকে সাথে পেল না, এজন্য কিছুটা অপরাধবোধ ছিল।
কিছুটা পথ গাড়ির রাস্তা ধরেই ট্রেক করতে হল। কয়েকটা মিনিভ্যান আর মোটরবাইক আমাদের পাশ দিয়ে গেল কিছু কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র নিয়ে। সামনেই দেখলাম কাজ চলছে, বাঁধ বানানো হচ্ছে, কাজটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, বাঁধটি ত্রিশূলী নদীর প্রবাহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বানানো হচ্ছে। সমতল রাস্তার পরের রাস্তাটা অনেকটা উপরের দিকে উঠে গেছে। সম্পূর্ণ ট্রেকেই ল্যাংটাং নদীটি ছিল আমাদের পাশে পাশে। সকাল ১০ টার দিকে আমরা খুব সুন্দর ছোট্ট একটা ছিমছাম হোটেলে চায়ের বিরতির জন্য থামলাম। এখানে সব হোটেলেই বিক্রির জন্য শাল মাফলার টুপি মোজা হ্যান্ড গ্লাভস থাকে। এগুলো অনেক রঙের থাকে, দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। আমরা মাসালা চা খেলাম, সমানভাবে চা ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পেলো ফারজানা। তৌকির একটা সুপ নিল, সবাই কাড়াকাড়ি করছিল, জানিনা কে কতটুকু খেতে পেরেছিল।
আমাদের সব ব্যাগগুলো সাজিয়ে রাখা ছিল। মাহির ব্যাগের সাইড পকেটে গামি বিয়ার চকলেট ছিল, হোটেলের মালিকের বাচ্চা প্রথম থেকে খুব ছোটাছুটি করছিল, ও সেই চকলেট টা দেখতে পেয়ে নিয়ে দৌড় দিবে, এমন সময় মাহি ধরে ফেলে, ওকে সেখান থেকে ২ টা চকলেট দিয়ে পুরো প্যাকেটটা ব্যাগের ভিতরে রেখে দেয়। বাচ্চাটা আমাদের সাথে অনেকক্ষণ ছিল আর কোন না কোন ভাবে আমাদের মজা দিচ্ছিল। ওর সাথে সরাসরি অনন্দ ভাগ করে নিতে যুক্ত হল আমাদের একজন, যে মনস্তাতিক ভাবে হোটেলের এই বাচ্চাটার চেয়ে খুব বেশী বড় না। হোটেলের পিছন দিকটায় টয়লেট, সরু কাদাটে পথ, কারণ পাশেই ত্রিশূলী নদীর বহমান পানি সারাক্ষণ ফিনকির মতো করে ভিজিয়ে যাচ্ছে।
শুরু হল বিরতি পরবর্তী ট্রেক এখনকার রাস্তা শুরুই হল বেশ উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ শুধু হাঁটা আর হাঁটা, উঁচু নীচু পাথর, পানি, যতদূর দেখা যায় পাথর আর পাথর…একসময় খেয়াল করলাম যে আমি আর মাহি একদমই পিছনে, বাকি সবাই চোখের আড়ালে এগিয়ে গেল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ব্যাম্বু, দুপুরে খাবারের বিরতি।
উঁচুতে হাঁটলে শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়, সমতল পথ এলে শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়। ট্রেক করতে গিয়ে মনে হয় যেন নিশ্বাস আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মনে মনে নিজের সাহসের জন্য গর্ব হচ্ছে, তেমনই কিছুটা ভয়ও হচ্ছে কারণ, মাত্র কিছুদিন আগেই আমার ডাক্তার নেপাল যেতে নিষেধ করেছিলেন, কারণ একটু উনিশ বিশ হলেই নিউমোনিয়া হয়ে যাবে! ভালোলাগার বিষয় হল, আমার শ্বাস-প্রশ্বাস কোনোই সমস্যা করছে না, শুধু হাঁটুটাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমি নিয়মিত শরীরচর্চা করি না। পাখির মিষ্টি শব্দ আর খচ্চরের গলার ঘণ্টার শব্দ বেশিক্ষণ আনমনে থাকতে দেয় না।
পাশেই প্রবাহিত নদী, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা চলে আসে; অনেকবার আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, কেন আমি এই ট্রেকে আসলাম? প্রতিবারই উত্তর পেয়েছি যে আমি মন থেকেই চেয়েছি; কারণ গতবছরই অর্ণব এই পোকা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমরা বেশখানিকটা পথ খাড়া নেমে ব্যম্বুতে পৌঁছলাম, কয়েকটি পাশাপাশি হোটেল একেবারে নদীর ধারে, তার উলটো দিকের পাহাড় থেকে সশব্দে গর্জন করে যাচ্ছে একটা ঝর্ণা, এখানে প্রতিটি হোটেলই পাহাড় আর ঝরনা বেষ্টিত। এখন আমার শরীর একটু বিশ্রামের জন্য অস্থির, ক্ষুধা তেমন না থাকলেও ছিল ক্লান্তি, এই কান্তি বার বার মনে করিয়ে দেয় যে আমি নিয়মিত ট্রেকার না। পাশ দিয়ে ঘোড়া অথবা খচ্চরের মাল বোঝাই করে হেঁটে যাওয়া ট্রেকে নিয়মিত দৃশ্য আর ওদের মলের গন্ধ নিত্যসঙ্গী! মাঝে মাঝে নিজেরা থেমে ওদের বহরকে জায়গা করে দিতে হয়, খুব মায়া লাগে, বোবা প্রাণী, ৪০/৫০ কেজি ওজন বহন করে উঁচু থেকে উঁচুতে যাচ্ছে, স্থানীয়দের জীবন ও জীবিকা সচল রাখছে। বাস্তুতন্ত্র চলমান রাখতে এই বোবা প্রাণীগুলোর ভূমিকা অনেক বেশী!
সুপ্ত আর কামরুলের সাথে মাহি রাগ করল কারণ ওরা জুতা খুলে বসেছে, কারণ জুতা খোলা আর পরাতে সময় নষ্ট হয়, সেই সময়টা বিশ্রাম নিলেও ভাল। সবাই ডাল ভাত নিল, এখানে ভাতের সাথে ছোলা বুটের তরকারি ছিল, যা আমাদের জন্য ভাতের সাথে কিছুটা বেমানান হলেও, শক্তি সঞ্চারের জন্য অনেক উপকারী হল। আমাদের গন্তব্য লামা হোটেল, পথে অনেকগুলো ছোট ছোট সাঁকোর মত ছিল। কয়েকটা নড়বরেও ছিল।
আজকের দিন আমাদের সবচেয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। দুপুরের পর ঘণ্টাখানেক আমি সাবলীলভাবেই হাঁটতে পেরেছি, তারপর ধীরে ধীরে আমার শক্তি আর ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। মূল দল থেকে আমরা অনেক পেছনে। একটা পোস্টার দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, ২৫ এপ্রিল ২০১৫, নেপালে একটি ভয়াবহ ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে ল্যাংটাং এর একটি গ্রাম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রায় দুই শতাধিক বাসিন্দা এবং ট্রেকার সহ বাড়ি এবং হোটেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চাপা পড়ে যায়। প্রায় ৭০০০ মানুষ মারা যায় সেই ভূমিকম্পে, সেখানে শুধু একজন ইসরায়েল ডিফেন্স অফিসার ২২ বছরের ‘অর আশরাফ’ মারা যায়। তিনদিন পর তার মৃত শরীর বেম্বো গ্রামেই খুঁজে পাওয়া যায় এবং ইসরায়েলের মাটিতে স্বসম্মানে দাফন করা হয়। চলতি পথে কিছু কিছু ব্যাপার চোখের সামনে আসে যা আপনাকে একদম থমকে দেয়! আচ্ছা, আশরাফের বাবা মা এই ২২ বছরের ছেলের মৃত্যু কী ভাবে মেনে নিয়েছে? এসব চিন্তা করতে করতে একজন মা হিসাবে আমার চোখটা ঘোলা হয়ে আসলো। মাহি তাগাদা দিচ্ছে কারণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার হয়ে যাবে, আমাকে একটু দ্রুত হাঁটাতে হবে। বেশ অনেকটা পথ সরু আর সমতল কিছুটা গ্রামের রাস্তার মত কিন্তু আমাদের ডান পাশটা একদম খাদ, একটু এদিক ওদিক হলেই কয়েকশো মিটার নিচে হারিয়ে যেতে হবে আশরাফের মত! আর বেশিক্ষণ আলো থাকবে না, আমাদের দ্রুত করতে হবে। পাহাড়ে হুট করে অন্ধকার হয়ে যায়। সারাদিন অনেক স্থানীয় মানুষ পথে দেখা গেলেও বিকেলের পর আর কাউকেই দেখা যায় না। ল্যাংটাং নদীর পাশ দিয়েই যেতে হয় ল্যাংটাং গ্রামে। এখানকার মানুষের জন্য পথ এই একটাই। খুবই রুক্ষ কঠিন এবং দুর্গম, এই পথ দিয়েই একটা জনপথের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু। আর একমাত্র যানবাহন গাধা অথবা খচ্চর।
এখন থেকে রিমচে পর্যন্ত শুধু উঁচু আর উঁচু, আঁকাবাঁকা সরু সব অসামঞ্জস্য সিঁড়ি। আমি ইতোমধ্যেই বাচ্চাদের মত করে হাঁটা শুরু করেছি, হাঁটুতে ভালোমতো জানান দিচ্ছে যে কষ্ট হচ্ছে। এখন আমার নিজের সীমা অতিক্রম করার সময় যাচ্ছে, প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের সাথে যুদ্ধ করছি, যাইহোক লামা হোটেল পৌঁছাতে হবে। প্রতিটা ধাপ শেষ হলেই পরের উঁচু সিঁড়িগুলো দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নাই, এগিয়ে যেতেই হবে, আমরা রিমচের খুব কাছাকাছি। মনে হচ্ছে আমাদের দল ইতোমধ্যেই লামা হোটেল চলে গেছে। চা আর খাবারের বিরতিসহ মোট ৯ ঘণ্টা ধরে হাঁটছি। অন্ধকার হোয়েই গেল, আমি বিরক্ত হয়ে হেডলাইট জ্বালাতে দিলাম না। সামনে একটা আলো দেখতে পেলাম, মাহি জানালো এই সিঁড়িগুলো শেষ হলেই রিমচে। আমার এক পা ফেলার শক্তিটুকু নাই। আমি জানিনা, কীভাবে আমি প্রায় ২০ টার মত সিঁড়ি উঠলাম! যে আলো দূরে থেকে দেখা যাচ্ছিল সেই হোটেলের বাইরের বেঞ্চে বসলাম, পানি খেলাম, মাহি হেডলাইট বের করল। সম্পূর্ণ ট্রেকে আমি ১৫-২০ মিনিট পর পর পানি খেয়েছি, মুখে গামী চকলেট অথবা ম্যাঙ্গোবার রেখেছি। কখনও বাফ গলায় দিচ্ছি, কখনো মাথায় দিয়েছি। আমরা রিমচে থেকে লামা হোটেলের দিকে হাঁটা দিব এমন সময় আমাদের পোর্টার মিংমা চলে আসলেন, উনি লামা হোটেলে ডাফেল ব্যাগ রেখে দেখতে এসেছেন যে আমরা কোথায়, কারণ আমাদের আগের দল প্রায় দেরঘন্টা আগেই পৌঁছেছে, শুধু ফারজানা, কামরুল, আমি আর মাহি বাকি ছিলাম। মিংমা দেখতে আসছে যে আমাদের কি হল! মানুষটার দায়িত্ববোধ আমাদের অনেক অবাক করল। রাস্তা শুরু হল নামার সিঁড়ি দিয়ে। অন্ধকারে ট্রেকিং অনেক ভাল লাগে, সামনের কিছু অংশ ছাড়া কিছু দেখা যায় না, শুধু হাঁটাতে ভালোভাবে ফোকাস করা যায়। এই অঞ্চলের পাথরগুলো অনেক চকচকে, হেডলাইটের আলোতে সিঁড়িগুলোকে মনে হচ্ছিল ডায়মন্ড খচিত কারুকাজ করা আর কিছুপথ গেলেই একটা রাজপ্রাসাদ পাব।
কেমন যেন এক অজানা শক্তি চলে আসলো শরীরে, ২৫ মিনিটে কোন বিরতি না দিয়ে, সারে সাতটায় পৌঁছে গেলাম লামা হোটেল, প্রায় ১০ ঘন্টা ট্রেকিং করে এই লামা হোটেলকে রাজপ্রাসাদতুল্যই মনে হল। অর্ণব এগিয়ে আসল আমাদের নিতে। জানলাম যে ফারজানা আর কামরুল কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছে। কেউ হয়ত বুঝতে পারেনি কিন্তু অর্ণব মায়ের জন্য টেনশন করছিল কারণ আমরা ২০০ গজের মত দূরে থাকতেই অর্ণব ডাইনিং এর হট্টগোলে থেকেই আমাদের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ছেলেটা অনুভূতি প্রকাশ করতে লজ্জা পায়। সেই মুহূর্তে আমার পায়ের যে অবস্থা, মাহি আর অর্ণবকে বললাম আমার জন্য যেন এখানেই রুম বুক করে রাখে, আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব না। রুমে যাবার জন্য যে ৫-৬ টা সিঁড়ি, এতেই আমার জান শেষ! পা দুটো একদম ভেঙ্গে আসছে, একদম নড়াতে পারছি না। রুম থেকে ডাইনিং আর টয়লেট যাওয়া ভীষণ কষ্ট হল। টয়লেট এ লো প্যান, এই পায়ের অবস্থা নিয়ে আমি চিৎকার করে করে কাজ সেরেছি। মনোবিজ্ঞান বলে যে আমরা যদি চিৎকার করি, আমাদের মস্তিষ্কে একটি খালি জায়গা তৈরি হয় এবং কিছু মুহূর্তের জন্য ব্যথা ভুলে থাকতে পারা যায়। এজন্যই আমরা ব্যথা পেলে নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠি। মনেই হচ্ছিল, আমি আর হাঁটতে পারবো না। মন খারাপ লাগছিল, কারণ আমি যদি এখানেই থাকি তাহলে আমার মোটামুটি ৭-৮ দিন একা এখানে থাকতে হবে।
পা সহ সম্পূর্ণ শরীর ব্যথায় আমার খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না, কিন্তু আমি জানি, পাহাড়ে ঠিকঠাক খাবার আর ঘুমই হল মূলমন্ত্র। অনেক কষ্ট করে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে কোনোমতে ডাইনিং এ বসলাম। একজন ফ্রান্সের ট্রেকারের সাথে পরিচয় হল, ওরা তিনজন, রুম পায়নি, তাবুতে থাকবে। আমাদের সাথে একজন আছে যে সকল বিষয়ে সার্টিফিকেট ধারী, ওর সাথে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বললো। যেহেতু মেয়েটা রুম পায়নি, আমরা আমাদের মধ্যে শতভাগ বাংলায় দুষ্টামি করে কথা বলছিলাম, কেউ ওকে নিজের ঘরে জায়গা দিতে চায় নাকি…কথার মাঝে সেই সকল বিষয়ে বিজ্ঞ মানুষটি যে শুরুতে মোবাইল না ব্যবহার করার প্রতিজ্ঞা করলেও, প্রতিটা হোটেলের ডাইনিং এ মোবাইলেই ডুবে থাকে আর হুট করে আগে পরে খেয়াল না করে, “কার রুম লাগবে” বলে গুবলেট করে দিল, এতে আমরা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কারণ, আমরা যাকে নিয়ে কথা বলছি সে আমাদের পাশেই, যদিও বিদেশি, একটা শব্দ শুনেও মুখভঙ্গি দেখে যদি বাকি কথা আন্দাজ করে ফেলে? আমি স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটাকে বললাম যে আমরা সম্পূর্ণ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু বাংলাদেশি হয়েও পারলাম না!
সময় নিয়ে ডাল ভাতের থালি সম্পূর্ণ শেষ করলাম, সাথে অনেক মজার একটা টমেটো ভর্তা ছিল। অর্ণব আমার পা টিপে দিচ্ছিল, সাদিক জানালো ওর কাছে জয়েন্ট পেইন এর ঔষধ আছে। ডাইনিং থেকে রুমে যেতে আমার যে অবস্থা হল তাতে আমি নিশ্চিত, আর কোথাও যেতে পারছি না। ঘুমানোর আগের সব কাজ শেষ করলাম, ছোট টয়লেট এর কাজ রুমেই সারলাম ইউরিনাল ডিভাইস দিয়ে, আমার সব ক্যাম্পিংয়ের নিত্যসঙ্গী এই ডিভাইস। সাদিকের দেওয়া ঔষধ খেলাম, পায়ে সরিষার তেল মালিশ করে দিল মাহি। আমি ছোটবেলা থেকে মুখ ঢেকে ঘুমাতে পারি, পাহাড়ে এই অভ্যাসটা কাজে লাগল, আমি সাধারণত গলা আর মাথায় দুইটা বাফ দিয়ে টাইট করে ঢেকে ঘুমাই। শুয়ে শুয়ে ভাবছি, আমি এতটা কঠিন ট্রেকের জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। Rope4 থেকে এর আগে দুইবার ইয়ালা ট্রেক হয়েছে, কেউ বলেনি যে এই পথটা এত কঠিন! মাহি, তৌকির অর্ণব, বছরে দুইবার পাহাড়ে বিভিন্ন দলের সাথে অভিযান করে, ভালোলাগার এই কাজটা করার জন্য অনেক কষ্ট করে! অনেক হতাশা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম, হয়ত সকালে সবাইকে বিদায় জানাতে হবে, তবে যদি না কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে…!
Leave A Comment