ইয়ালা ডায়েরী – পর্ব ১
আমি অনেক বছর পর নেপাল যাচ্ছি, শেষবার গিয়েছিলাম আব্বুর সাথে ২০১৯ সালে ৩ দিনের জন্য। মাত্র ৩ টা দিন, অথচ কত কত স্মৃতি! আমার এভারেস্ট ফ্লাইট আর কুন্তল দার সাথে শেষ দেখা! গতবছর থেকে অর্ণব শখ করে রেখেছে আমি যেন ইয়ালা অভিযানে যাই, এজন্য টাকা ব্যবস্থাপনার কি একটা যেন হিসাব দিয়েছিল, আমি বুঝি নাই…!
যেকোন অভিযান অথবা ইভেন্টের আগে অফিসটা হয়ে যায় বিয়েবাড়ির মত! সবাই ২/১ দিন আগেই চলে আসে, হৈ হুল্লোড় চলতে থাকে। এবার মাহি আর অর্ণব আগে থেকে নেপালে ছিল, আমি বাকি সবাইকে একসাথে করে নিয়ে যাবো। ডেঙ্গুর জন্য ফারজানা ১ সপ্তাহ আগে থেকেই ছিল, সুপ্ত অনেক দিন আগে থকেই আমার সাথে ছিল। কামরুল আসল ২ দিন আগে। বাকীরা আগের রাতে। চূড়ান্তভাবে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। সব লেয়ারের ক্লদিং, মুজা, হ্যান্ড গ্লোভস, হেড লাইট, ব্যাটারী, ড্রাই ফুডস, ট্রেকিং পোল, সানগ্লাস, টুপি ও অন্যান্য সব ব্যক্তিগত জিনিস. এসব জিনিসে মধু আর সরিষার তেল অত্যাবশ্যকীয়। যেকোন অভিযান অথবা ভ্রমণে গেলে ব্যাগ গোছানোটা একটা বড় ব্যাপার, কারণ অনেক সময়ই আমারা এমন সব জিনিস নিয়ে ব্যাগ ভরে ফেলি যে সেখান থেকে অনেক কিছুই কাজে লাগে না। তাই চেক লিস্ট করে আর ভেবে চিন্তে জিনিস বহন করা উচিৎ। আমাদের ইয়ালা অভিযানের অনেক আগেই অর্ণব দলের সবার জন্য অনলাইনে একটা চেক লিস্ট করে দিয়েছিল। যা সবার জন্য অনেক উপকারী ছিল।
৩ নভেম্বর ২০২৪
রাতে হালুয়া বানিয়ে রেখেছিলাম যেন সকালে সবাই কিছু অন্তত খেয়ে যেতে পারে, কামরুল সকালে ডিম সিদ্ধ করল, আমি ভাবলাম, ইমিগ্রেশন করে লাউঞ্জে বসে কিছু খেয়ে নিব, মনে মনে ক্রোসেন আর কফিতে চুমুক দিচ্ছি…”আপু তুমি কি উবার কল করেছ”? সুপ্ত আপু শব্দটা একটু টেনে বলে, মাঝে মাঝে ভাল লাগে আবার বিরক্তও লাগে, কখন যে কোনটা লাগে বুঝি না। ওকে বললাম, উবার অনেক সময় নেয়, এরচেয়ে আমরা নিচে গিয়ে সিএনজি নিয়ে নেই, তাড়াতাড়ি হবে। সবাই মিলে বের হলাম। নুরীকে দেখি হাতে শপিং ব্যাগ, জানতে চাইলাম, কি? ও বললো জুতা, আর ওর পায়ে স্যান্ডেল। আমি বললাম ট্রাভেল এ ভারি জুতা পরে নিতে হয়, এতে ব্যাগের ওজন কমে যায়। ও বল্ল, এটা তো কেউ বলে নাই! তিনটা সিএনজি ঠিক করা হল, আমার সাথে নুরী ছিল, বেচারি যুদ্ধ করে বড় ব্যাগের ভেতর থেকে ড্রাই ব্যাগ বের করল, যার জন্য ওকে মোটামুটি অর্ধেক জিনিস বের করতে হয়েছিল, জুতা পরে নিল। ওর চকচকা জুতা দেখে আমি আমার বুট জোড়া মিস করতে থাকলাম। আমার সেই একটা সেলিব্রেটি বুট, যা পুরুলিয়া, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, আইল্যান্ড পিক আর মেরা পিক থেকে ঘুরে এসেছে, এখন ইয়ালা অভিযানে যাওয়ার আগে আজকেই কাঠমান্ডু এসে পৌঁছাবে আর একদিন বিশ্রাম পাবে!
এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক, আমরা ৯ জন যথাসময়েই এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। দুইজনের কাছে টিকেট প্রিন্ট করা ছিল না, অনুরোধ করে ঢুকে গেলাম। বোর্ডিং এর আগেই নুরী টিকেট প্রিন্ট করে নিয়ে আসলো কারণ আমরা জানতাম, নেপাল ইমিগ্রেশনে ভিসার জন্য টিকেট কপি জমা দিতে হয়, কিন্তু পরে আসলে দিতে হয়নি। আর বোর্ডিং এর পর ইমনের মনে হল ওর ও তো টিকেট প্রিন্ট করতে হবে। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবাই একসাথেই ইমিগ্রেশনের জন্য গেলাম। সবাইকে আসতে আসতে বার বার একটা কথাই বলছিলাম যেন কেউ এটা না বলে যে আমরা ৯ জন একসাথে, এতে ইমিগ্রেশন ঝামেলা করতে পারে। আমরা কয়েকটা লাইনে ভাগ করে দাঁড়ালাম। এক লাইনের সামনে ছিল কামরুল, উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। কি মনে করে কামরুল আমার পেছনে ফারজানা, তার পেছনে চলে আসলো। এখন ওই লাইনের সবচেয়ে সামনে তাহমিদ, আমাদের স্পন্সর, ও অস্থির স্বভাবের মানুষ! দূর থেকে বুঝতে পারলাম তাহমিদ হাতের ইশারা করে বলছে আমরা একসাথে। বুঝলাম, যা ঝামেলা হওয়ার হয়ে গেছে, সাদিকের দিকে তাকালাম, বুঝলাম মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমাদের ৯ জনকে এক অফিসারের রুমে পাঠানো হল, আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, “আমি এখান থেকে ২/৩ জনকে চিনি, বাকি সবাই নিজ নিজ ভাবে নেপাল যাচ্ছে, এটা সত্যি যে আমরা সবাই নেপাল একসাথে যাচ্ছি কিন্তু সবাই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসছে, কেউ কেউ এখনো ছাত্র/ছাত্রী”, আমার কথা শুনে অফিসার বললেন, যাদের অন্যান্য ভ্রমণ আছে, তাদের ছেড়ে দাও, আর যাদের একদম প্রথম ভ্রমণ তাদের পাশের রুমে পাঠাও।
আমি আর সাদিক একদম সহজ ভাবে ইমিগ্রেশন পার করলাম। কামরুল বুদ্ধি করে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, ওকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে, ওর ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখতে চেয়েছিল, তারপরে ছেড়ে দিল। এটা নিয়ে আমরা অনেকবার ওর সাথে মজা করেছি! এখন বাদ থাকলো সুপ্ত, ফারজানা, ইমন, নুরী, তাহমিদ। দেখি, সাদিক ইমিগ্রেশনের দিকে খুব টেনশন নিয়ে তাকিয়ে আছে, আমাদের নরম সরম ফার্মের বাচ্চা সাইফ, ওর নেপালে একবার ভ্রমণ থাকলেও ইমিগ্রেশন অনেক পেঁচাচ্ছে, উপায় অন্তর না দেখে, আমি তৎক্ষণাৎ একটা অনলাইন বুকিং দিলাম, সাইফের ই-মেইল অ্যাড্রেস নিয়ে, ও ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আর আমি বাইরে থেকে ওর সাথে কথা বলছি, মনে হল কখন যে পুলিশ আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে দেয়! যাই হোক, এর মধ্যে আমাদের ৫ পাপীর ইমিগ্রেশন হয়ে গেল, আমি ওদের চেক ইনের জন্য চলে যেতে বললাম, আর সাদিক সহ সাইফের অপেক্ষা করতে থাকলাম। ৯ টা ৩৬ বাজে, আমাদের ফ্লাইট ১০ টা ৫ এ…চলে আসলো সাইফ। প্রথমেই ওকে বললাম যে বুকিং টা ক্যান্সেল কর জলদি!
চেক ইনের সময় আমার ব্যাগ ছিল ফারজানার কাছে। ওকে ধরল কারণ অনেক বেশী ব্যাটারি একসাথে এভাবে নেওয়া যাবে নে, এর জন্য ব্যাগ ক্লেইম করতে হবে। আমি গেলাম, অফিসারকে বল্লাম যে আমরা নয় জন একসাথে, আর সবার ৩ টা করে সবগুলো ব্যাটারি আমার কাছে, আমি যদি সবাইকে তার ব্যাটারি গুলো দিয়ে দেই, তাহলে তো আর সমস্যা নেই? অফিসার হেসে দিলেন কারণ ফারজানার আর আমার বয়স এর পার্থক্যটা উনি বুঝলেন যে এখানে আর হাইকোর্ট দেখানো যাবে না! তাহমিদ থেকে থেকে কয়েকবার করে ওর বোকামির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে, অনেক ভদ্র একজন মানুষ।
আমাদের মোটামুটি সবার সিট বুক করা ছিল, সবারই উইন্ডো সিট, শুধু আমার জন্য ওয়াক-ওয়ে সিট কারণ আমি উইন্ডো সিট পছন্দ করি না! প্লেন টেক অফ করার আগ মুহূর্তের যে গতি, সেটা আমার অনেক পছন্দ, আমার খুব শখ, কোন একদিন আমি ট্যাক্সি ওয়েতে হাই স্পিডে গাড়ি চালাব। সবকিছু মোটামুটি ঠিক হয়ে যাবাও পরও ২০২২ সালে আমার গাড়ি কেনা হল না, সে টাকা চলে গেল হাসপাতালে…সে এক বিরাট গল্প…! আবহাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল থাকায় আমরা খুব স্পষ্ট ভাবে এভারেস্ট দেখতে পেলাম। সবাই অনেক উদ্দীপ্ত ছিলাম এভারেস্ট দেখার জন্য, তাহমিদ সুপ্তর সাথে কথা বলছিল, সুপ্ত মনোযোগ দিয়ে এভারেস্ট দেখতে পারছিল না! আমরা ঠিকমতো গিয়ে ত্রিভুবন পৌঁছালাম। অনেক মানুষ! আমরা ঢাকা থেকে যে ফর্ম ফিল আউট করে নিয়েছিলাম ওটা নেপালে কাজ করে নাই, সবাই আবার ফর্ম ফিল করলাম, ইমিগ্রেশন শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। মাহি বাহিরে অপেক্ষা করছিল। মাহি আমাদের আগে থেকেই বলে দিয়েছিল যেন সিম সবাই এয়ারপোর্ট থেকে কিনে, কারণ থামেলে দাম বেশী। সবাই সবার কাজ শেষ করে গেটের কাছে আসলাম আর ইমন তখন গেল সিম কিনতে, সবাই ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছেলেটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে…সবকিছু পরে খেয়াল করে। অভিযানের শেষের দিকে অবশ্য ইমন অনেক প্রাণবন্ত সময় উপহার দিয়েছে।
ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে আমাদের স্বাগত জানানো হল। মাহি সবসময়ই কিছু পরীক্ষামূলক কথা বলে আর কাজ করে এতে করে দলের সবার মনে অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঠিক তাই হল, উত্তরীও দেবার সময় মাহি কিছু মজা করল। আমি হলুদ রঙের উত্তরীয়, বিজয়ীরা লাল আর অন্যান্য সবাই সাদা রঙ পেলাম। সব ধরনের বয়েসের সমন্বয় হয়েছে এই দলে, তবে ৯৪ সালে জন্ম নেওয়া সাদিকই সবচেয় মুরুব্বি এই দলে, আর সর্বকনিষ্ঠ নুরী, ওর আর আমার পার্থক্য মাত্র ২০ বছর অথবা ৭৩০৫ দিন! বাচ্চা একটা মেয়ে! কেউ বিচলিত হবেন না, মুরুব্বী আর কনিষ্ঠের হিসাবে মাহি আর আমাকে আনা হয় নাই!
গত প্রায় ১২ দিন ধরে মাহি যে হোটেলে ছিল, সাকুরা বুটিক হোটেল, অনেক ভাল লাগল আমার। সবাই ব্যাগ রেখেই চলে গেলাম আল মদিনা তে ভাত খেতে। সবাই যার যার পছন্দ অনুযায়ী খাসি, মুরগী, বাফ, এসব দিয়ে খাওয়া শুরু করল। আমাদের খাওয়ার সময় আমাদের ভেতরকার শিষ্টাচার বের হয়ে আসে, কেউ একদম ডুবে যায় খাবারে, কেউ নিজের পাশাপাশি অন্যদের খেয়াল রাখে, কাউকে দেখলে মনে হয় ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে, জীবনে অনেক তাড়াহুড়া, কেউ আবার এতই ধীরে খায়, কেউ অনেক মজা নিয়ে খায় আবার কেউ, খেতে হবে যেন তাই খাচ্ছে, আমই ব্যক্তিগতভাবে খাবারের সময় মুখের যে চপচপ শব্দ খুব অপছন্দ করি, আর অনেক কেই দেখেছি, সেই ছোট্ট বয়সে ঢেকুর দিলে যেমন মা সহ পরিবারের সবাই খুশি হয়ে যায়, বড় বয়সেও তারা ভেবে নেয়, বিরাট এক ঢেকুর দিলে মনে হয় আশেপাশের সবাই খুশি হয়ে যাবে আর বাহবা দিবে! হাঁচি, কাশি, ঢেকুর সবই নিত্য দিনের ব্যাপার, এটা মনে রাখা উচিত যেন কারো একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার অন্যকে অস্বস্তিতে না ফেলে। আমরা যারা অ্যাডভেঞ্চারে আছি, ক্যাম্পিং এর সময় এরকম অনেক অবস্থা তৈরি হয় যখন ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ভদ্রতা করে বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করে আসা যায় না! এবারের ইয়ালা বেস ক্যাম্পেও এরকম ঘটনা হয়েছে!
যেহেতু কালকের দিন আমরা কাঠমান্ডুতে আছি, তাই যার যা কেনার সবাই দেখে রাখল। আমার মনে হচ্ছিল একটা হাঁটুর সাপোর্ট হলে ভাল হত। মাহিকে বললাম। আমি জানি, মাহি অনেক দেখবে তারপর সবচেয়ে ভালটা কিনবে। অভিযানে সবচেয়ে ক্লান্তিকর ব্যাপার হল প্রতিটা গন্তব্যে নতুন করে ব্যাগ গোছাতে হয়। কাঠমান্ডু, সাইব্রুবেশি, লামা হোটেল, কেঞ্জিং গুম্ফা সহ সব জায়গায়ই রাতে আর সকালে ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। আমার সাধারণত, ব্যাগ গোছানোর সময় আর পরে কিছুক্ষণ মাথা চক্কর দিতে থাকে। পরে সারা দিন কী কী লাগবে তা সামনে রেখে বাকি সব ডাফেল ব্যাগে চলে যায়, যে ব্যাগটা কম বেশী ২০/২৫ কেজি ওজন হয়, এই ব্যাগ নিয়ে প্রতিটা গন্তব্যে সবচেয়ে আগে যে পৌঁছায় সে হলেন আমাদের পোর্টার! এই অভিযানে আমাদের পোর্টার ছিলেন মিংমা আর লাল। মানুষের শরীরে কত শক্তি থাকলে তাঁরা, পাথুরে পথে, ঝিরিপথে, সরু সিঁড়িপথে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস তোয়াক্কা না করে এত বেশী ওজন মাথায় নিয়ে অনেক দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়! আমাদের এবারের পোর্টার দুজন প্রতিটা বিরতিতেই আমাদের খাবার এগিয়ে দিয়েছে, পানি এনে দিয়েছে এছাড়াও সবসময় অনেক সহযোগী মনোভাবের ছিল।
অনেক নামিদামি সব ব্র্যান্ডের দোকানে গেলাম, বিভিন্ন জিনিস দেখলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, যেকোনো সময় অভি, শান্তা, অর্ণব আর তৌকির এসে পৌঁছাবে! ওরা সফলভাবে মেরা সেন্ট্রাল পিক সামিট করেছে ৩০ অক্টোবর তারিখে। যেন নভেম্বরের ৩ তারিখ রাতের মধ্যে কাঠমান্ডু পৌঁছাতে পারে তাই মাঝে একদিন ১২ ঘণ্টা ট্রেক করেছে সবাই! সবাই যখন কেনাকাটা আর জিনিস দেখায় ব্যস্ত, আমি মাঝে একটা ক্যাফেতে গেলাম, ওদের পেস্ট্রি গুলো এত সুন্দর দেখতে যে আমি লোভ সামলাতে পারলাম না, একটা ম্যাঙ্গো মুজ পেস্ট্রি আর কফি নিলাম। পেস্ট্রি মুখে নিতেই বুঝলাম ঠাণ্ডা ছিল! মাত্র কয়েকদিন আগেই ঠাণ্ডাজনিত ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। যেকোন ফ্রিজের জিনিস খাওয়া একদম নিষেধ করেছেন ডাক্তার। আচ্ছা আমি যে ২ দিন পর থেকে নিজেই ফ্রিজের মধ্যে থাকবো, আর চিন্তা করতে চাইলাম না যে সাইব্রুবেশি থেকে শুরু করে সামনের দিনগুলো কেমন হবে… আমার খাওয়া হতে হতে মাহি চলে আসলো। আমি মেরা টিমের জন্য একটা ছোট্ট কেক নিলাম, অনেক কিউট ছোট্ট কেক! দলের জন্য উত্তরীও নিলাম, হোটেলে গেলাম, অপেক্ষা করছি নিচে… একটু রুমে গেলাম, এই ফাঁকে ওরা চলে আসলো। ওদের জন্য আমরা আগেই চারজনের জন্য একটা বিরাট রুম বুক করে রেখেছিলাম, কারণ ওরা একসাথে থাকতে চাচ্ছিল। সেই বিশাল চারজনের রুমে আমরা ছোট্ট করে মেরা টিমের একটা সংবর্ধনা করে ফেললাম।
আর সেই ছোট্ট কেকটা ডিনারের সময় খাবো বলে রেখে দিলাম। ঘরের মধ্যে এতগুলো মানুষ, এত হৈ হুল্লোড়, অথচ নুরীকে দেখলাম নিজের মধ্যে ডুবে আছে, এই প্রথম ওর এত বেশী অন্যমনস্ক থাকাটা চোখে আসলো। কিন্তু ওর এই অন্যমনস্ক ভাবে ডুবে থাকাটা কখনই ওর ফিটনেস বা ট্রেকিং এর দক্ষতায় কোন কমতি আনতে পারেনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুবই বিচক্ষণতার সাথে সম্পূর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছে! আয়োজনে মনযোগ দিলাম, সবাইকে উত্তরীও পরিয়ে দেওয়া হল, অর্ণব আর শান্তার একই সাথে দ্বিতীয় ৬ হাজার মিটার পর্বতে সফলতা, অভির জন্য প্রথম! আর তৌকিরের জন্য ৫ম বারের মত! সবচেয়ে ভাল লাগার বিষয় হচ্ছে, ওরা ফুরফুরে আছে এবং অর্ণব আর তৌকির, পরবর্তী অভিযানে যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত! সবাই ছোট করে অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি জানালো, সাথে আমাকেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হল! এই মানুষগুলার সাথে থাকলে আমি এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে থাকি। অনেক ভাল লাগে, মনে হয় যেন এই প্লাটফর্ম আরও বড় হোক আর অনেক ছেলে মেয়ে পাহাড়ে যাক আমাদের হাত ধরে।
রাতে আবার আল মদিনা তে খাওয়া হল। এবার অনেকেই রুটি খেল আর সেই চপ চপ শব্দ তো আছেই মনোরঞ্জন করার জন্য। ইয়ালা টিম আর মেরা টিম ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে বসলো হিসেবের সুবিধার জন্য। উল্লেখ্য যে ওদের চিকেন মাসালা অনেক মজা আর পরিমাণে অনেক বেশি, ২ জন খেয়েও শেষ করা যায় না। নেপালে আমার একটা ফল এত পছন্দ হয়েছে, প্রতি বেলা সবাই আমাকে আতা খেতে দেখেছে, এই বেলা আমি আতা খাওয়ার সময় অর্ণব আর তৌকিরের মুখে দিয়ে দিচ্ছিলাম। আমি খেয়াল করলাম, আমি তৌকিরকে আমার বাচ্চার মত করেই আদর করি। আমাদের একটা ছবি দেখে কেউ বলেছিল, “আপনার কি যমজ ছেলে”? তখন প্রথম খেয়াল করেছিলাম ওদের দুজনের চেহারাও অনেক মিল! সেই ছোট্ট কেকটা একটু একটু করে সবাইকে ভাগ করে দিল অভি, সাথে হোটেলের অন্যান্য সবাইকেই কেকের মাধ্যমে ওদের মেরা পিকে সফলতার আনন্দ ভাগ করে দিল।
আমাদের টেবিলের কেউ কেউ নিজের টেবিলের খাবার শেষ করে মেরা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল আর কিছুটা লুটপাটের মতই চলল কিছুক্ষণ, ‘রোগানজোস’ নামের কোন আইটেম নাকি অনেক মজা, আমার কাছে তেল মশলা আর গোশতের টুকরা ছাড়া কিছু মনে হল না! আমি ছোট বেলা থেকে মাছ গোশত পছন্দ করি না, কোন তেমন স্বাদ লাগে না!
আজকের মত দিন শেষ করা দরকার, খাবার হোটেল থেকে বের হয়ে, ঘুমানোর হোটেল সাকুরাতে গেলাম, অনেক ক্লান্ত, ঘুম দরকার। সকালে বিসমিল্লাহ্ হোটেলে নাকি আমাদের নেহারী খেতে হবে, অনেক নাকি মজা! আমি মনে মনে ভাবছি ইশ যদি সবজি পাওয়া যায় তাহলে রুটি দিয়ে মজা করে নাস্তা করতে পারবো আর মাহিকে সান্ত্বনা দেবার জন্য নিহারীর ঝোল দিয়ে চালিয়ে দিব। ও হ্যাঁ, ফেরার পথে সকালের জন্য আতা কিনতে কিন্তু ভুল হয়নি…
৪ নভেম্বর ২০২৪ – দিন ২
মনে হচ্ছিল যে সকালে উঠতে পারবো না, কিন্তু সুন্দর করে ৬ টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল, আলসেমি করে আরও আধঘণ্টা শুয়ে থাকলাম। প্রথম গন্তব্য বিসমিল্লাহ্ হোটেল, ছোট্ট দোকান। মওত চারটা টেবিল আচে, একটা চামচ বাটি রাখার ছোট টেবিল আর ক্যাশের টেবিল। দোকানের মালিক অনেক আন্ত্রিক, বেশ অনেকটা আদনান সামির মত দেখতে। বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কের ঝড় (brainstorm) হল, কে কী খাবে? কে কার সাথে জুটি হবে? এইসব সিধান্ত হতে হতে হয়েক মিনিট লেগে গেল, আমি এর মধ্যে আতা খাওয়ার দায়িত্ব শেষ করলাম, প্রতিবারই কেউ না কেউ ভাগ পায়, এবার পেল সাদিক। আর একজন ভাগ নয়া চাইলেও আপনাআপনি মুখে চলে যায়! কাল থেকেই খাবারের একটা পাকা পোক্ত জুটি হয়েছে, ফারজানা আর সুপ্ত। বাকিরা সুবিধা আর পছন্দের ভিত্তিতে বার বার জুটি পরিবর্তন করে যাচ্ছে! এখন আর মেরা/ইয়ালা দলের কওন ভাগ হল না, সবাই এক দল হয়েই বসলাম। আমি মুরুব্বী হবার কারণে সবসময় ভাল এবং সুবিধাজনক জায়গা পাই, এটা মনে হয় কিছুটা সুযোগ নেবার মতই!
নাস্তা আসলো। দল বড় হলে, এত বেশী মজা আর হৈ হুল্লোড় হয় যে কখন ২ টা নান রুটি শেষ করে ফেললাম, বুঝতেই পারলাম না। ঠিকমত অন্যে নেই, পায়া অথবা নিহারি আসলেই অনেক মজা ছিল! নাস্তা শেষে আড্ডা আর চা পর্ব বাইরে দাঁড়িয়ে। আমরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিলাম আর কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিচ্ছিলাম।
আশেপাশে অনেক বাংলাদেশই, থেকেই বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে। যাদেরকে দেখলাম, বেশিরভাগকেই টুরিস্ট মনে হয় নাই। কারো কারো চাল চলন দেখে কিছুটা বাসিন্দার মত মনে হচ্ছে, জানি না কতদিন ধরে আছেন? হোটেল ঠেকে বেড় হলেই আর ইন্টারনেট পাচ্ছি না, এটা একটু খাপছাড়া লাগছে। আসার সময় অমির কাছ থেকে এন্সেল সিম এনেছিলাম, ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়াতে আর মোবাইল নেট পাচ্ছি না। আব্বু সকালে আর রাতে কল দেয়, তাই ইন্টারনেট আমার জন্যয় বাধ্যতামূলকভাবে চাই। শুনলাম, নামাস্তে সিম নাকি অনেক উপর পর্যন্ত নেট সাপোর্ট দেয়।
আজ সারাদিনে মাহিকে কয়েকবার হাঁটুর সাপোর্টের কথা মনে করিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন কেনাকাটা বিষয়ক কাজ ছিল না। শান্তার কাছ থেকে গ্লাভসের ইনার আর সাদা একটা আপার ইনার নিলাম। দলের সবাই প্রয়োজনমত ডাউন, আউটার, ফ্লিস, গ্লোভস, জুতা, মুজা সহ অন্যান্য জিনিস দিনব্যাপী কেনাকাটা করল। আমি সারাদিন পর বিকালের দিকে ১২শ রূপী দিয়ে নামাস্তে সিম কিনলাম। মাহি অভিযানের সব ডলার রূপী করে নীল। আমার সিমটা নুরীকে দিলাম। ঢাকা থেকে আর নেপালে নেমেই যে মানুষটা বারবার বলেছিল যে ও একবারে ঢাকায় ফেরার আগে আর ফোন ব্যাবহার করবে না! কিন্তু প্রতিটা জায়গায় সবচেয়ে আগে যে ওয়াই ফাই এর পাসওয়ার্ড নিয়েছে সবচেয়ে আগে, আশ্চর্যজনক সে কোন সিম কিনল না! কিন্তু সে একটা পাটের ব্যাগ কিনল। মাহি ওকে স্পষ্টভাবে বলে দিল এই ব্যাগ যেন ও কাঠমান্ডু রেখে যায়…বাকিটা ইতিহাস।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে গেলাম মদন দার দোকানে। মেরা টিমকে অভিনন্দন জানালো মদন দা। সদ্য আইল্যান্ড পিক সামিত করে আসা লিসা, সাফকাত আর ইউসুফের সাথে দেখা হল মদন দার দোকানের সামনে।আমরা সবাই গতকালই দাদার দোকানে এসেছিলাম। স্লিপিং ব্যাগ ভাড়া নেওয়ার কাজ করে রাখল মাহি। ওখানেই একটা দোকানে ভাল মানের ডাউন পাওয়া যায়, ওখানেই সবাই গেল। আমিও পেছন থেকে ওদের সাথে যেতে চাইলাম, এত চিপা সিঁড়ি জ্যা দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা! নিচে নেমে আসলাম। মদন দার দোকানটা আমাদের একদম নিজেদের মত, দাদা না থাকলে মাহি, তৌকির জিনিসপত্র বিক্রিও করে! শেষের দিন, তৌকির এক সুন্দরই মেয়ের সাথে প্লেয়িং কার্ড নিয়ে অনেকক্ষণ দামাদামি করছিল, মনে হল যেন দাম টা আসল ব্যপার ছিল না, দামাদামি করে সময় পার করাটাই মুখ্য ছিল!
দুপুরে খাবার সময় আমাদের মেরা টিমের একজন শেরপা, সাহে দেখা হল, ওনাকে আমাদের শুভেচ্ছা হিসাবে rope4 এর টিশার্ট দেওয়া হল। উনি আমাদের সাথে খাবার খেলেন। আমাদের BMTC টিমের সাথে দেখা হল। আমাদের নতুন পর্বতারোহীরা বিপ্লব ভাইয়ের মত অভিজ্ঞ একজন পর্বতারোহীর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেল। রিনি আপু তাহমিদের BUP এর সরাসরি শিক্ষক। নেপালের ম্যামের সাথে দেখা হয়ে তাহমিদ অনেক উল্লাসিত হল। বিপ্লব ভাই আমাকে দেখে একটু অবাক হলে কারণ, এত বছরে এই প্রথম আমি Rope4 টিমের সাথে নেপালে!
মেরা অভিযান শেষ করে মুজিব ভাই, আমাদের সাথে সাকুরা হোটেলে উঠলেন। তৌকির আর মুজিব ভাই ভিসার মেয়াদ বাড়াতে, হাই কমিশনের অফিসে গেল, ওখানে ওদের অনেক সময় লেগে গেল আর মদন দার জান শেষ অবস্থা হয়ে গেল! উৎসব উপলক্ষে সরকারি অফিস আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় দুজনের ভিসা ফি মদন দা কয়েকজনের কাছ থেকে ব্যবস্থা করে অনলাইন ব্যংকিং এর মাধ্যমে সমাধা করল। এর মধ্যেই দাদার কাছে আমাদের সবার কিছু না কিছু প্রশ্ন আছেই, যা উত্তর মদন দা হাসিমুখে দিইয়ে যাচ্ছে। একজন নিতান্তই ভাল আর ধৈর্যশীল মানুষ!
সন্ধ্যার পর মাহি, তৌকির আর অর্ণব টাকার হিসাব নিয়ে বসল। আমি বরাবরই টাকার হিসাব বুঝি না, তাই কোন কথা বল্লাম না। শুধু ২ হাজার রুপী তৌকিরের কাছ থেকে ভাংতি করে নিলাম, ভাংতি মানে সেই ভাংতি! সব ১০, ২০, ৫০ এর নোট! হিসাবের এক পর্যায়ে অর্ণব ঘুমিয়ে গেল। অনেক ক্লান্ত। আমরা রাতের খাবার খেতে যাওয়ার আগে ওকে অনেক ডাকলাম, কিন্তু কোনভাবেই চোখ খুলতে পারল না। আমরা ওকে রেখেই চলে গেলাম। খাবার টেবিলে বসে ফোনের পর ফোন দিচ্ছি, অর্ণবের কোন সারা শব্দ নাই। অভিকে বল্লাম, ও অর্ণবকে ডেকে আনতে ব্যর্থ হল। পরে ও নিজে নিজেই উঠে খেতে আসল। ততক্ষণে আমাদের সবার খাওয়া চলে আসল।
হোটেলের পাশের রুমটায় ইমরান, পার্থ, তালহা আর আসাদ খাবার খাচ্ছিল, খাওয়া শেষ করে আমাদের সাথে দেখা করতে আসল। মেরা অভিযানের জন্যয় সবাইকে শুভেচ্ছা জানানো হল, আর পার্থকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে আসার জন্য অনেক বাহবা দেওয়া হল। পর্বতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে বিচক্ষণতা আর পরিপক্বতা! খেতে আসার আগেই মাহি জানিয়েছিল, আমরা বাসের টিকেট পাইনি, জীপে যেতে হবে। এই এক অভিযানে দেশের এত এত বেশী মানুষের সাথে দেখা হল…! অভিযাত্রীর তিন জন, BMTC দলের চারজন, আর বেঙ্গল ট্রেকারস এর চারজন! খাওয়া শেষে আমরা সবাই একটু ঘোরাঘুরি করে হোটেলে চলে আসলাম। সকালের জন্য চূড়ান্ত ব্যাগ গোছানো হল। টিম ভাগ করে ডাফেল ব্যাগ দেওয়া হল, সবাইকে নিজেদের জিনিস দিয়ে ডাফেল গুছিয়ে ফেলতে বলা হল। আমার মনে হচ্ছিল, এতে সুপ্তর অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, সকালে আমার মনে হওয়ার সত্যতা সুপ্তর কথার মাধ্যমে পেলাম! আমারা সবাই সব কাজ পারবো না, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যখন কোন দলে থাকবো, দেখেও অনেক কিছু শিখতে জানতে পারি…!
পরদিন সকালে আমরা সাইব্রুবেসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো, কানে ভাসছে নেপালী গান আর একই ধারার সুর…
চলবে…
Leave A Comment